Image description

গণভোটের জটে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আয়োজনের পদ্ধতিগত উপায় জানা না থাকাই এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির মূল কারণ। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মাঝপথে গণভোটের ইস্যুটি সামনে উঠে আসায় কিছুটা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে ইসি।

এদিকে, সরকার থেকে এ ইস্যুতে কী ধরনের দিকনির্দেশনা আসে, তা এখনো জানে না কমিশন। ইসির মতে, সবকিছু আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই কমিশন পর্যায়ে এ নিয়ে কোনো আলোচনা না হলেও গত রোববার কমিশনের অতিরিক্ত সচিবের কক্ষে অনানুষ্ঠানিক একটি সভা হয়েছে। সেখানে সংকটগুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনার মধ্যে সভা শেষ হয়। ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ইসির তথ্যমতে, গণভোট নিয়ে দুটি জটিলতা রয়েছে। হ্যাঁ বা না ভোট এক নয়, একাধিক ক্রাইটেরিয়ায় হবেÑএ নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে ইসি। ব্যালটে একটি পদ্ধতি হলে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একদিনে করা সহজ হবে। কিন্তু পদ্ধতির ধরন একাধিক হলে (পাঁচ কিংবা সাতটি) মহাজটিলতায় পড়বে ইসি। কারণ, গণভোটের ব্যালটে একাধিক পদ্ধতি থাকলে সাধারণ, স্বশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের ক্ষেত্রে ভোটদান কঠিন হবে। এমনকি এই পদ্ধতিতে শুধু গণভোটের ব্যালটে মতামত প্রকাশ করতেই ন্যূনতম দুই থেকে তিন মিনিট ব্যয় হবে। এরপর সংসদ নির্বাচনের সাধারণ ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ব্যালটে ভোট দিতে হবে।

এ বিষয়ে গত দুদিনে ইসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার দেশ-এর কথা হয়েছে। তারা গণভোটের পদ্ধতি নিয়ে জটিলতার কথা জানিয়ে বলেছেন, সবকিছু সরকারের ওপর নির্ভর করছে। গণভোট আদৌ হবে কি হবে না, এখনো সরকার কমিশনকে কিছুই জানায়নি। কিন্তু কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বসেছিলেন। ওই সভায় যদি দুটি ভোট একত্রে হয়, তাহলে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স কতটি লাগবে, সেটির সংকুলান কীভাবে করা যায়, প্রবাসী ভোটারদের এই গণভোটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না ও বাজেট কেমন লাগতে পারেÑএমন ১০ থেকে ১২টি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হয়।

ইসির একজন কর্মকর্তা জানান, স্থানীর সরকার নির্বাচনের ক্রয় করা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স দিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব; আলাদা কেনার দরকার নেই। তবে বাজেট নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কারণ, এখন পর্যন্ত সংসদ নির্বাচনের জন্য দেওয়া চাহিদার দুই হাজার কোটি টাকার বিপরীতে এক হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেছে। এখনো এআই এবং আউট কান্ট্রি ভোটারদের বাজেট যুক্ত করা হয়নি।

অপর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, গণভোটের বিষয়ে সরকার থেকে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারছি না একটি ফিল্টারে (পয়েন্ট) হবে, নাকি সাতটি ফিল্টারে হবে। গত ১৯৭৭, ৯৫ ও ৯১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটি একটি পয়েন্টে হয়েছিল। যেমন, রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমটি ঠিক আছে বা বেঠিক আছে, অর্থাৎ ইয়েস অর নো। এ পদ্ধতিতে হলে জাতীয় সংসদ ও গণভোট একত্রে করা যায়। কিন্তু যদি সাতটি পয়েন্টে হয়, তাহলে একদিনে করা কঠিন হবে।

তবে গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ এখন প্রকাশ্যে। বিএনপিসহ সমমনা কিছু রাজনৈতিক দল সংসদ ও গণভোট একদিনে করার পক্ষে। অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন ভিন্ন তারিখে দুটি নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো গণভোটে রাজি নয় তার দল বিএনপি। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন যেদিন অনুষ্ঠিত হবে, সেদিনই গণভোট হতে হবে। বিএনপির অবস্থান হলো গণভোট অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের দিনে হতে হবে। তাও একই ভোটকেন্দ্র, কর্মকর্তা ও ব্যালট বাক্স ব্যবহার করে অনুষ্ঠিত হতে হবে। বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন মত দেয় এনসিপিও। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে।

অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আমরা চাই গণভোট নির্বাচনের আগেই হোক। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি জাতীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না করে নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে গণভোট হতে পারে। গতকাল সোমবার ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ মোহাম্মদ আবু তাহেরও নভেম্বরে গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছেন।

অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না করে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট করা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আবদুর রহমানেল মাছউদ। গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তার বক্তব্যকে কমিশনের মুখপাত্র হিসেবে নয়, ব্যক্তিগত মতামতে এ কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

ইসি আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না করে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট করা উচিত। একই দিনে দুই ভোট করতে সক্ষম নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে গণভোট আয়োজনে ঘোষিত ফেব্রুয়ারির সময়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

ইসি বলেন, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হলে বড় ব্যয় সাশ্রয় হবে। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গেই সম্ভব। তবে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ কিছু বাড়ানো লাগতে পারে। এতে আইনগত কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। সরকার চাইলে গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী আমার দেশকে জানান, জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে চাইলে সংসদের আগে গণভোট হওয়া শ্রেয়। এর মাধ্যমে জুলাই সনদের ভিত্তি তৈরি হবে। আর গণভোট সংসদে পাস হওয়ার দরকার নেই। যারা বলছেন, না বুঝেই বলছেন। দুটি নির্বাচন পৃথক হলে ব্যালটে একাধিক পয়েন্টে মতামত প্রকাশ করতে পারবে জনগণ।

যতবার গণভোট

স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক গণভোট; আরেকটি সাংবিধানিক গণভোট। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় গণভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে, ১৯৮৫ সালে। সবশেষ গণভোট ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হয়েছিল।