
পাঁচ বছর পর ফের জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ। উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টারের এটি সপ্তম জাতীয় শিরোপা। ৫৯ বছর ৬ মাস বয়সে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন নিয়াজ মোরশেদ সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের মুখোমুখি হয়েছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার ব্যক্তিগত ও বাংলাদেশের দাবার অজানা অনেক কিছুই।
ঢাকা পোস্ট : পাঁচ বছর পর আবারও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হলেন
নিয়াজ : সময়ের ব্যবধানে পাঁচ বছরের বেশি। ২০১৯ সালের পর তিনটি আসর হয়েছে। ২০২০ সালে করোনায় খেলা হয়নি আর ’২৩ সালে ফেডারেশন আয়োজন করতে পারেনি। এবার আমি ভালো এবং ধারাবাহিক খেলেছি। আবার চ্যাম্পিয়ন হলাম ভালোই লাগছে।
ঢাকা পোস্ট : ৫৯ বছর বয়সে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এই বয়সে দাবার বোর্ডে মনোযোগ রাখা এবং ধারাবাহিকভাবে খেলা কতটা চ্যালেঞ্জিং
নিয়াজ : অবশ্যই অনেক কঠিন অস্বীকার করার উপায় নেই। দাবা খেলা আমি ভালোবাসি। দাবার বোর্ডে তেমন ক্লান্তি পায় না। তবে যখন গেম খেলে রাতে বাসায় ফিরি অনেক ক্লান্ত লাগে। এতটাই ক্লান্ত লাগে কাল আরেক রাউন্ড খেলতে হবে এটা মাথায় আসলেই কেমন যেন লাগে। বোর্ডে অবশ্য স্বাভাবিকই থাকি। কিছু সময় বয়সের জন্য একটু এনার্জিতে ঘাটতি হয় তবে সেটা অভিজ্ঞতা দিয়ে পূরণ হয়ে যায়।
ঢাকা পোস্ট : এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনাল খেলছে ১৪-১৫ বছরের দাবাড়ু। সেখানে বাংলাদেশের দাবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ৫৯ বছর বয়সী একজন।
নিয়াজ: ১৯৭৯ সালে ১২ বছরর ১১ মাসে আমি সর্বকনিষ্ঠ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এখন ৫৯ বছর ৬ মাস বয়সে বয়োজ্যেষ্ঠ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ডওটা আমার। মনে হয় না বিশ্বের অন্য দাবাড়ুর একই সঙ্গে এ রকম দু’টি জাতীয় রেকর্ড রয়েছে। ৫৯ বছর বয়সের কেউ জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে এটা মোটেও দেশের দাবার জন্য ভালো না। বিশ্ব দাবার মান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে আমরা কতটা পিছিয়ে সেটার প্রকৃত উদাহরণ।
ঢাকা পোস্ট : ৮২ বছর বয়সে রাণী হামিদ এখনো খেলছেন এবং অলিম্পিয়াডেও টানা ছয় গেম জিতেছিলেন গত বছর
নিয়াজ: উনি আমাদের অনুপ্রেরণা। ৬০ মোটামুটি একটা স্বাভাবিক বয়স কিন্তু ৮২ বছর বয়সে মানুষের হাঁটা-চলাই দায় হয় সেখানে উনি প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলছেন এবং দেশের হয়ে বিদেশে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এটা সত্যিই অনন্য উচ্চতার।
ঢাকা পোস্ট : এবার দুই আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমান ও মনন রেজা নীড়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন লড়াই হওয়ার অনুমান ছিল। ফাহাদ আপনার সঙ্গে লড়াই করলেও নীড় এবার শিরোপা রেসেই ছিল না।
নিয়াজ : ফাহাদ শেষ রাউন্ডের আগে হারেনি। মাঝে কিছু ড্র করেছে। ফাহাদ এবং নীড় দুজনই একাডেমিক পরীক্ষার মাঝে খেলেছে। এজন্য পারফরম্যান্স একটু কম ছিল বলে মনে হয়। তবে ওরা দুই জনই আমাদের সামনের ভবিষ্যত পাশাপাশি সাকলাইন ও তাহসিন।
ঢাকা পোস্ট : আপনি উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। জাতীয় দাবায় সর্বোচ্চ ১৪ বার চ্যাম্পিয়ন জিয়াউর রহমান। আপনি এবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাত। উপমহাদেশে দাবায় আপনি প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার সেখানে জাতীয় দাবায় শিরোপায় পেছনে এটা কেমন লাগে আপনার?
নিয়াজ: ১৯৮২ সালে টানা চার বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমি একটানা ১৩ বছর জাতীয় দাবা খেলিনি। কারণ ঐ সময় আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কেউ ছিল না। ১৯৮০-৯০ পর্যন্ত আমি টানা খেললে বিশ বারের কাছাকাছি থাকতে পারতাম। ফেডারেশন থেকে সেই সময় আমাকে খেলতে নিরুৎসাহিত করত কারণ জাতীয় দাবা খেলা মানে আমার সময় ব্যয় এর চেয়ে বিদেশে টুর্নামেন্ট খেলা কার্যকরী এবং অন্যদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আমি সরাসরি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছি।
১৯৯৬ সালের পর যখন আবার আমাকে জাতীয় দাবা খেলতে বলা হলো তখন আমি আবার উচ্চশিক্ষায় বাইরে ছিলাম। ২০০৩ সালের পর আবার দাবায় সক্রিয় হই। এরপরও নিয়মিত খেলিনি। সব মিলিয়ে আমি বিশটিরও বেশি প্রতিযোগিতায় অংশই নেইনি।
ঢাকা পোস্ট : আপনার সাত বারের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যে কোনটা স্মরণীয়?
নিয়াজ: অবশ্যই প্রথমবার। ১৯৭৮ সালে আমি রেজাউল ভাই সমান পয়েন্টধারী ছিলাম। টাইব্র্রেকিং রেজাউল ভাই চ্যাম্পিয়ন হয়। পরের বছরই আমি জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন হই। তখন আমার বয়স মাত্র ১২ বছর ১১ মাস। সেই শিহরণ ও উন্মাদনা ছিল ভিন্ন মাত্রার। ঐ সময় দুই-তিনটি পত্রিকায় আমার ছবি প্রকাশ হয়েছিল। যেটা আমার কাছে অমূল্য।
ঢাকা পোস্ট : ২০২৫ সালে এসেও জাতীয় দাবার চ্যাম্পিয়ন অর্থ মাত্র অর্ধলক্ষ টাকা। একটা দেশের একটা খেলার সেরা। সেটার পুরস্কার এত কম
নিয়াজ: জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে প্রাইজমানি অবশ্যই বাড়ানো দরকার। সবচেয়ে কষ্টের একে তো প্রাইজমানি প্রয়োজন ও বাস্তবতার তুলনায় অনেক কম এরপর আবার সেটাও বকেয়া থাকে।
ঢাকা পোস্ট : আপনি তো অর্থনীতিতে আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ধীরে ধীরে বাড়লেও ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলায় অর্থনীতির বাজার এখনো সীমিত কেন
নিয়াজ : এটা আমারও প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা। সাফল্যের বিচারে ফুটবল, ক্রিকেটের চেয়ে অন্য অনেক খেলা এগিয়ে। এরপরও সেই খেলাগুলোর খেলোয়াড় আর্থিকভাবে সুরক্ষিত নয়।
ঢাকা পোস্ট : প্রায় পাঁচ দশক আপনি দাবার সঙ্গে। জাতীয় দাবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানের একাল-সেকাল কিভাবে দেখেন
নিয়াজ : যখন শুরু করেছিলাম তখন সামগ্রিক মান সেই রকম ছিল না। আমার টানা চারবার চ্যাম্পিয়ন ও জাতীয় দাবা না খেলেন সরাসরি জাতীয় দলে খেলার বিষয় বুঝতে পারছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যায়। দাবার সেরা সময়টা ছিল মাঝামাঝি সময়। যখন একাধিক গ্র্যান্ডমাস্টার সক্রিয় ও সেরা ফর্মে ছিল। এখন গ্র্যান্ডমাস্টাররা অনিয়মিত এবং সামগ্রিক দাবার মানও আগের চেয়ে পড়তির দিকে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার দাবার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দাবাড়ু কাজী মোতাহের হোসেনের সঙ্গে খেলেছেন।
নিয়াজ : আমার বয়স যখন নয় উনার তখন ৭৮। উনার দাবার এত আগ্রহ উনি আমার বাসায় এসে খেলতেন। উনার সঙ্গে আমার ভালোই লড়াই হতো কখনো জিততাম আবার ড্র করতাম আবার হেরেছিও। বিকেলে আমি ফুটবলও খেলতাম। উনি সাধারণত বিকেলে আসতেন এজন্য ফুটবল খেলতে না পেরে ঐ সময় বিরক্ত হতাম (হাসি)। উনি দাবাড়ু হিসেবে উঁচু মানের। সত্তর দশকে আরেক জন দাবাড়ু আমার এখনো মন দাগ কেটে আছে কাজী সাদিক। উনার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার মতো প্রতিভা ছিল।
ঢাকা পোস্ট : জিয়াউর রহমান প্রতি টুর্নামেন্টে খেলতেন। গত বছর জিয়া জাতীয় দাবা খেলতে খেলতে পৃথিবী ছেড়েছেন। তাকে এবার মিস করেছেন
নিয়াজ: খেলার সময় তো বটেই, গত এক বছর ধরেই ওর শূন্যতা বয়ে বেড়াই। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ওর সঙ্গে চেনাজানা। আমার মনে হয় ওর পরিবারের পর কেউ বেশি মিস করলে সেটা আমিই।
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিয়াডে বেশি অংশগ্রহণ সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে অনেকের কাছে জিয়া বাংলাদেশের সেরা দাবাড়ু। আপনি দেশের তো বটেই উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। আপনি ও জিয়ার মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করবেন কিভাবে?
নিয়াজ : আমার এবং জিয়ার সঙ্গে তুলনাটা সেভাবে করা যায় না। কারণ আমার সেরা সময় ছিল নব্বইয়ের আগে। আর জিয়ার সেরা সময়টা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। দুই জনের দুই সেরা সময় এক হলে তখন সেটা তুলনাযোগ্য হয়। জিয়া অত্যন্ত ভালো ছেলে দাবা অন্তঃপ্রাণ। তার শূন্যতা দাবায় পূরণ হওয়ার মতো নয়। আমি ও জিয়া দুই জনই ভালো খেলোয়াড় তবে কিংবদন্তি নয়।
ঢাকা পোস্ট : আপনি দেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার, জিয়া সবচেয়ে বেশিবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন আপনারা কিংবদন্তি নয় কেন?
নিয়াজ: আমার কাছে খেলার মানদন্ডে যিনি বৈশ্বিক পর্যায়ে শীর্ষ স্থানে থাকবে তিনিই প্রকৃত কিংবদন্তি। সেই হিসেবে সাকিব আল হাসানই বাংলাদেশের একমাত্র কিংবদন্তি। যিনি অনেক দিন বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর ছিলেন। আমি প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার সেটা আঞ্চলিক পর্যায়ে, মোশাররফ ভাই এক গেমসে পাঁচ স্বর্ণ জিতেছেন সেটাও সাফ অঞ্চলে। একটি খেলায় বৈশ্বিক অবস্থানে শীর্ষে যারা ধারাবাহিকভাবে থাকেন তারাই আমার কাছে কিংবদন্তি। তবে অন্যদের কাছে অন্য রকম ব্যাখ্যা থাকতেই পারে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার এই যুক্তিতে তাহলে গলফার সিদ্দিক ও আরচ্যার রোমান সানা সাকিবের অবস্থানেই থাকবেন। কারণ তারা সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যা আগে কেউ পারেননি।
নিয়াজ: তারা ভালো খেলোয়াড়দের চেয়ে আরও উঁচু পর্যায়ের। কিংবদন্তি হতে হলে আপনাকে সেই খেলায় বৈশ্বিক অবস্থানে পৌঁছাতে হবে। অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করা অবশ্যই আমাদের দেশীয় বাস্তবতায় অনেক বড় অর্জন।
ঢাকা পোস্ট : ৫৯ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়ন হলেন। আর কত দিন খেলতে চান
নিয়াজ: এটা আসলে বলতে পারছি না আর কত দিন খেলব। মাঝে মধ্যে মনে হয় খেলা ছেড়ে দেই। এখনো খেলা উপভোগ করছি। তবে খেলার চেয়ে আমি দেখি অনেক বেশি। যেটা মনে করি আমাকে এখনো কিছুটা এগিয়ে রাখে। এবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের বাছাইয়ের অনেক খেলাই আমি দেখেছি।
ঢাকা পোস্ট : অনেক খেলোয়াড় আবার কোচ হিসেবে নিজেকে ছাপিয়ে যান। আপনিও কোচিং করান। কোচ নিয়াজ সম্পর্কে দাবাড়ু নিয়াজের মূল্যায়ন কি?
নিয়াজ : আমার কয়েকজন স্টুডেন্ট ভারতে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে। বাংলাদেশে আমার একমাত্র ছাত্র ফাহাদই। নারী দাবাড়ুদের আরও উন্নত কোচিং ও প্রশিক্ষণ দরকার। ফেডারেশন আমাকে নারীদের কোচিংয়ে ডাকেনি কখনো। আমার চেয়ে জিয়াই বেশি কোচিং করিয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : তামিম ইকবাল সম্প্রতি বিসিবি সভাপতি হতে চেয়েছিলেন। কাজী সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি ছিলেন, সাঁতারু মোশাররফ সাঁতার ফেডারেশনের সেক্রেটারি ছিলেন। দাবা ফেডারেশনের দায়িত্বে আপনার আশার কোনো ইচ্ছা রয়েছে কি না
নিয়াজ : ফেডারেশনে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। যত দিন পারি খেলব ও কোচিং করাব। খেলাতেই মূলত আমার আনন্দ।
ঢাকা পোস্ট : দাবা নিয়ে আক্ষেপ ও আশা
নিয়াজ: বাংলাদেশের দাবা আরও ভালো অবস্থানে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেটা হয়নি। আশা করি সামনে নীড়, ফাহাদরা গ্র্যান্ডমাস্টার হবে। নারী দাবাড়ুরাও উঠে আসবে।