
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কোটা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে অভিহিত করায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন দ্যা ডেইলি অবজারভার পত্রিকার অফিসে বসে ছিলাম। আমি সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। হাসিনার সেই কথাগুলো যখন টেলিভিশনে শুনি, আমি ও আমার সহকর্মীরা থমকে যাই। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে ফেলি—একটা কিছু হয়ে উঠতে চলেছে, যা হাসিনা ও তার সহযোগীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বড় প্রভাব ফেলবে।
রাত ১০টার দিকে আমি অফিস থেকে বের হয়ে টিএসসির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) অফিসে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজু ভাস্কর্যের দিক থেকে স্লোগানের আওয়াজ ভেসে আসে। দৌড়ে সেখানে পৌঁছালে দেখি, বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা দলে দলে এসে জড়ো হচ্ছে হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে। সবচেয়ে চোখে পড়ে যে বিষয়টা, সেটা হলো নারী শিক্ষার্থীদের বিপুল উপস্থিতি—তারা সংখ্যায় পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে।
চারদিক গর্জে উঠেছিল তীব্র স্লোগানে—“তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার” এবং “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।” প্রথম স্লোগানের দ্বিতীয় অংশ “কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার” যুক্ত করেন রাজনীতি সচেতন ছাত্ররা। আমি প্রথম এই স্লোগানটি শুনি বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেলের মুখে। তিনি কিছুটা চিন্তিত ছিলেন। হাসিনার শাসন এই স্লোগানটিকে আন্দোলন দমন করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, এমন ভয় ছিল তার।
এদিকে, উপাচার্যের বাসভবনের সামনেও শিক্ষার্থীদের আরেকটি দল জড়ো হয়। সেখানে আমার বন্ধু জাহিদ আহসানের সঙ্গে দেখা হয়। সে হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “মামা, এইটাতেই হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যেতে পারে।”
পরদিন সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দুপুর নাগাদ আমি টিএসসিতে একটি মিছিল অনুসরণ করছিলাম। তখন হঠাৎ দেখি ডুজা মেসেঞ্জার গ্রুপে মেসেজ আসছে, ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে হল পাড়ায়। কবি জসিম উদ্দিন হল, মুজিব হল, জিয়াউর রহমান হল ও বিজয় একাত্তর হলের মধ্যবর্তী এলাকায়। দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই, কিন্তু সংঘর্ষ ততক্ষণে চরমে পৌঁছেছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমি একটা বড় গাছের আড়াল থেকে, ভাবনা চত্ত্বরের পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।
সেখান থেকে আমি দেখি, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মজহারুল কবির শয়ন ও একাত্তর হল ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনুস ধারালো অস্ত্র হাতে ছাত্রদের তাড়া করছেন। তাদের মুখ ও মাথা হেলমেট দিয়ে ঢাকা। অপরদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল শুধু ইট-পাটকেল ও কাঠের লাঠি। শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের পিছু হঠতে হয়, তারা মাল চত্ত্বরের কাছে ভিসি চত্ত্বরে গিয়ে জড়ো হয়। সেখানেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হামলা চালায়। নারী শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায়নি। শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়।
এই ঘটনার কিছু ছবি আমি পোস্ট করি ফেসবুকে। আহতদের মধ্যে আমার বন্ধু ইংরেজি বিভাগের আলিদুজ্জামান তূর্যও ছিল। আমি ক্যাপশনে লিখি, “ঢাবি এখন রণক্ষেত্র।” পোস্টটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়।
১৬ জুলাই, আমি শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যখন শহীদ আবু সাইদের মৃত্যু সনদের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে লেখা ছিল, “ব্রট ডেড।” আমি এটা আমার ফেসবুক টাইমলাইনে সংশোধন করে লিখি “ব্রট মার্টায়ার্ড” এবং সেটা শেয়ার করি। মুহূর্তেই সেটা শত শতবার শেয়ার হয়।
১৭ জুলাই, হাসিনার পতনের দাবি আরও জোরালো হয়, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উচ্ছেদ করা হয়। সকাল থেকেই শুরু হয় হল দখলমুক্ত করার কাজ। রোকেয়া হলে প্রথম অভিযান। সূর্যসেন হলে অভিযান চালায় আমার বন্ধুরা—মোস্তফা আহমেদ, রাকিব উদ্দিন ও আমার রুমমেট কাউসার ভাই। আমরা যখন সেখানে পৌঁছি, তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনান, ঢাবি সভাপতি মজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের রুমগুলো ভাঙচুর করা হচ্ছে।
সেদিন বিকেলেই ঢাবি প্রশাসন জানিয়ে দেয়, হল খালি করে দিতে হবে। আমরা অনেকেই হল ছাড়ব না বলে শপথ নেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে দেয়—তারা সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। দুপুর নাগাদ ভিসি চত্ত্বরে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আমি সেটা কভার করতে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমার বন্ধু তারেক রেজা ইমামতি করেন। দোয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা টিএসসির দিকে মিছিল শুরু করি। কিন্তু পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি—কোথায় যাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না—কারণ ভিসি চত্ত্বর ও রোকেয়া হল দুই দিক থেকেই পুলিশ গুলি ছুঁড়ছিল।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আমি দেখি হাসনাত আবদুল্লাহ ভাই দু’হাত ছড়িয়ে পুলিশকে বলছেন, “এইটা আমার ক্যাম্পাস। আমি এখানেই থাকবো। আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো।” সেই মুহূর্তে আমরা দেয়াল টপকে আম বাগান এলাকায় ঢুকে যাই। কলাভবনের পাশেই। লাফিয়ে নামার সময় আমার প্যান্ট ছিঁড়ে যায়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী ভাই একটা আবর্জনার স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেন, আমরা ধোঁয়া শ্বাসে টেনে কিছু সময়ের জন্য স্বস্তি পাই।
এরপর পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছে যায়, তখন আমরা মধুর ক্যান্টিনে আশ্রয় নিই। কিন্তু সেখান থেকেও দ্রুত চলে আসতে হয়, আশ্রয় নিই মল চত্ত্বরে। সেদিন আমি সম্ভবত সূর্যসেন হলের দ্বিতীয় শেষ ব্যক্তি হিসেবে বের হই। আমার বন্ধু আরিফুল ইসলাম ইমন—যিনি একসময় ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—সম্ভবত শেষজন ছিলেন। ১৫ জুলাইয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নারকীয় হামলার পর থেকেই সে দল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
১৯ জুলাই, শুক্রবার, আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিপোর্টিংয়ের দায়িত্বে ছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জুমার নামাজ আদায় করতে পারিনি। কারণ আমি ব্যস্ত ছিলাম আহতদের নাম নিবন্ধন করতে। তারা আসছিলো বাড্ডা, রামপুরা, মোহাখালী, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ি, রায়েরবাগ, আজিমপুর, আফতাবনগর ও পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে। রোগীর ঢল এতটাই ছিল যে, একদিকে নাম লিখছি—অন্যদিকে নতুন কেউ ঢুকছে অন্য পাশ দিয়ে। রিকশা, সিএনজি, অটো—সব পথেই রোগী আসছিল একসঙ্গে। সারাদিন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ থামেনি।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম ঘটনাস্থল, আহতদের নাম, এবং তারা কীভাবে আহত হয়েছেন—সব ডকুমেন্ট রাখতে। কিন্তু দিনের শেষে আমি আর সব তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি, কারণ আহতের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে, সবকিছু ধরা সম্ভব হয়নি।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমি দেখি আমাদের পত্রিকার ফটোগ্রাফার খন্দকার আজিজুর রহমান সুমন ভাইকে এক ফটোসাংবাদিক ধরে জরুরি ওয়ার্ডে নিয়ে যাচ্ছেন, বাম দিক থেকে তাঁকে সহায়তা করছিলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে ডান দিক থেকে তাঁকে ধরে সহায়তা করি। তাঁকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার ভীষণ রাগ আর কষ্টে হয়। সুমন ভাইয়ের দুই পায়ে ৪০টিরও বেশি প্যালেটের ক্ষত ছিল। হাসিনার শাসনের বর্বরতা তখনও থেমে থাকেনি।
হাসপাতালে একদল তরুণ, যারা তাদের আহত বন্ধুকে নিয়ে এসেছিল, আমাদের ওপর চিৎকার করে উঠল। আমাদের প্রেস কার্ড দেখে তারা রাগে বলে, “দালাল!” আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। বরং তাদের শান্ত করতে বলেছিলাম, “ভাই, দেখুন, আমাদেরও ছাড় দেয়নি ওরা। এই যে উনার পায়ের অবস্থা দেখেন। হাজার হাজার মানুষ হাসিনাকে অভিশাপ দিচ্ছে। এই ফ্যাসিস্ট শাসন আর বেশিদিন চলবে না। আমরা যারা মাঠে কাজ করি, আপনাদের সঙ্গে আছি।”
এতক্ষণে শত শত গুলিবিদ্ধ রোগী হাসপাতালে পৌঁছেছে, চিকিৎসকেরা একেবারে হিমশিম খাচ্ছিলেন। প্যালেট ইনজুরির মতো ক্ষেত্রে চিকিৎসা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুমন ভাইয়ের পায়ের এক্স-রে করার পর ওষুধ দিয়ে বলেন, কয়েকদিন পর আবার আসতে। সেখান থেকে আমরা সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে যাই। সেখানে দৃশ্য ছিল আরও ভয়ংকর—জরুরি ওয়ার্ডের মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। আমার ভাইদের এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সেখানকার চিকিৎসকদের বিরক্ত করিনি—পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।
সুমন ভাই বারবার বলছিলেন, “আমার ক্ষত তো কিছুই না। ওদের দিকে তাকাও।” অনেক রোগীই অঙ্গ হারিয়েছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই শহীদ হয়েছেন।
এরপর আমরা নিটোর-এ যাই। সেখানেও একই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। পরে সুমন ভাই তার এক বন্ধু চিকিৎসককে ফোন দেন। আমরা তখন বুলবুল ভাইয়ের বাসায় যাই, সেখানে ঐ চিকিৎসক এসে বলেন যে, প্যালেট ইনজুরি দীর্ঘমেয়াদে বড় কোনো ক্ষতি করবে না, তবে কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। মজার বিষয়, ঐ চিকিৎসক একজন আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলেন—এত মানুষ মারা যাওয়ার পরও তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না।
এরপর আমরা আগারগাঁওয়ে বুলবুল ভাইয়ের বাসার পাশের একটি গলির ফার্মেসিতে যাই। সেখানে ফার্মেসির মালিক, যিনি সুমন নামেই পরিচিত, সুমন ভাইয়ের পা ধুয়ে ড্রেসিং করে দেন খুব যত্ন করে। আমি সেদিন রাত এবং পরবর্তী দুই দিন সুমন ভাইয়ের বাসাতেই ছিলাম। আমরা অনেক কথাবার্তা বলছিলাম, চারপাশের কষ্টের কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, “আল্লাহ কি এসব দেখছেন না? তিনি চুপ কেন?” সুমন ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “আল্লাহ সব দেখছেন। আমরা খুব শিগগিরই স্বাধীনতা পাবো। আর যদি জীবন দিতে হয়, তাও দেব।”
২২ জুলাই আমি আবার মতিঝিলে দ্য ডেইলি অবজারভার অফিসে ফিরে যাই। সবাই ভাবছিল আমি হয়তো নিখোঁজ বা মৃত। কারণ দুইদিন ধরে অফিসের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। এরপর কয়েকদিন আমি অফিসের কাছেই সাকিব ভাইয়ের হোস্টেলে ছিলাম।
এই সময় শুনতে পাই—নাহিদ ইসলাম ভাই, আসিফ মাহমুদ ভাই, এবং আবু বাকের মজুমদার—তিনজনকে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। যতদূর মনে পড়ে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার প্রথমে তাদের অপহরণের খবর প্রকাশ করে।
২৪ জুলাইয়ের দিকে সীমিতভাবে ব্রডব্যান্ড সংযোগ ফিরে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে ঢুকে ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেলে তোলা ছবিগুলো পোস্ট করি—রক্তাক্ত দেহ, নিথর চোখ, নিজেদের রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে—বর্বরতা অস্বীকার করার উপায় ছিল না।
পরদিন দুপুরের দিকে ছাত্রশিবিরের তৎকালীন ঢাবি সভাপতি সাদিক কায়েম ভাই ফোন দেন। তিনি জানতে চান আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে নাহিদ ভাই ও আসিফ ভাইয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবো কিনা, কারণ তাদের সেখান থেকে আবার গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) তুলে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হই। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই সাদিক ভাই আবার ফোন দেন। বলেন, ফোনে তথ্য নিলেই হবে, যেতে হবে না। সেদিন রাতেই আসিফ ভাই আমাকে কল দেন। বলেন, তাদের ব্রডব্যান্ড কেটে দিয়েছে, ল্যান্ডলাইনও তুলে নিয়েছে। তিনি অনুরোধ করেন যেন ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের মাধ্যমে আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের খবর পৌঁছে দেওয়া হয়—আন্দোলন যেন থেমে না যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ডুজা গ্রুপে তা জানিয়ে দিই।
রাতে সাদিক ভাই আমাকে মেসেজ দেন, “কিছু কর্মসূচি ঠিক করেছি। শহীদ হতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু এইটা শেষ করতেই হবে। নতুন কিছু জানলে আমাকে জানিও ভাই।” তখন আমি সাকিব ভাইয়ের হোস্টেল ছেড়ে টিএসসির গেস্ট হাউজে উঠেছি। এই সময় আমি অনেক ঘটনাই কভার করি, বিশেষ করে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল।
এসময় আমার বন্ধু আবদুল কাদেরের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি ঘোষিত হয়, যার মধ্যে একটি ছিল হাসিনার ক্ষমা প্রার্থনা। যখন ইন্টারনেট আবার কেটে যায়, তখন এই দাবিগুলো ছড়ানো হয় সিমকার্ডের মাধ্যমে পাঠানো টেক্সট মেসেজে। উৎস জানার জন্য আমি ঐ নম্বরে ফোন দিই, যেখান থেকে বার্তা আসছিল। আমার সন্দেহ ছিল কাদের-ই হয়তো এসবের পেছনে। ফোন ধরলেন সাদিক ভাই। ভান করলেন যেন আমাকে চেনেন না। বললেন, “আপনি কি সাংবাদিক তৌসিফ?” আমি বললাম, “জি।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম কাদের কি ৯ দফা দিয়েছে? তিনি দেরি না করে বললেন, “জি হ্যাঁ।” তখনই আমি বুঝলাম—শিবির কৌশলে পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে, কাদেরকে আড়ালে রেখে পুরো পরিকল্পনাটা চালিয়ে যাচ্ছে।
৩০ জুলাই, সাদিক ভাই আবার ফোন দিয়ে বলেন, “মেসেজটা দেখো।” আমি ইনবক্স খুলে দেখি, তিনি একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন—সারাদেশে আদালত ঘেরাও কর্মসূচির রূপরেখা। তিনি একটি নাম চাচ্ছিলেন। আমি কিছুক্ষণ ভেবে বলি, “মার্চ ফর জাস্টিস”। তিনি একদম দেরি না করে নামটি পছন্দ করে কর্মসূচির দিন ঠিক করে ফেলেন।
আমি “মার্চ ফর জাস্টিস” কভার করি ঢাবির দোয়েল চত্বরে। বিএনপি-সমর্থিত শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তারা ছাত্রদের পুলিশের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। মিছিল যখন হাইকোর্টের দিকে যাচ্ছিল, পুলিশ তখন বাধা দেয়। এদিকে বুয়েটের ছাত্ররাও আন্দোলনে যোগ দেন, আন্দোলনে নতুন গতি আসে।
সেদিনই শিবিরের তৎকালীন ঢাবি সাধারণ সম্পাদক এসএম ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন করেন। তিনি “মার্চ ফর জাস্টিস” নাম দেওয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। এরপর বলেন, একটা ভার্চুয়াল ক্যাম্পেইনের নাম দরকার—সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ যেন জুলাইয়ের আন্দোলনের স্মৃতি ও ছবি পোস্ট করতে পারে। আমি চারটা নাম প্রস্তাব করি, তার মধ্যে একটি ছিল: “রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ”। ফরহাদ ভাই বললেন, দুই শব্দের নাম হলে ভালো হয়। রাতে দেখি, আমি যে নাম দিয়েছিলাম, সেটিই ১ আগস্টের ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের নাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এটি সফলতাও পায়।
৩ আগস্ট, আমার সাদিক ভাইয়ের সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়। আমি তাকে প্রশ্ন করি—তারা কেন তিন দিন আগে কর্মসূচি ঘোষণা করছে? আমি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি—এইভাবে আগেভাগে জানিয়ে দিলে হাসিনার পক্ষে আন্দোলন দমন করা আরও সহজ হয়ে যায়। তিনি রেগে গিয়ে জবাব দেন, “আমি একা নাকি এখানে? অনেক স্টেকহোল্ডার আছে। আমি যা খুশি, তা একা করতে পারি না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করতে হয়।” আমাদের মতবিরোধ সত্ত্বেও, ওই দিন ঘটে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত—শহীদ মিনারের পাদদেশে এক দফা দাবি ঘোষিত হয়: হাসিনার পতন। আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম, সংবাদ কভার করছিলাম। মানুষের ঢল দেখে সেখানেই একটি কবিতাও লিখে ফেলি।
ঐ রাত এবং ৪ আগস্টের ভোর, ইতিহাসে পরিচিত হয়ে ওঠে "লাইলাতুল গুজব" নামে। দেশে-বিদেশে গুজব ছড়িয়ে পড়ে—ছাত্রলীগ নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো পুনর্দখল করে নিয়েছে। তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিন চালু হয়ে যায়, আন্দোলনের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা মিথ্যাচারকে জিততে দিইনি। আমি, ছিদ্দিক ফারুকসহ কয়েকজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক সারারাত না ঘুমিয়ে কাজ করি গুজব প্রতিরোধে। তখন পুরো দেশ তাকিয়ে ছিল ঢাবির দিকে। গুজব খণ্ডন করতে আমরা রজু ভাস্কর্যে যাই, সবাইকে প্রমাণ করে দিই—ক্যাম্পাস এখনো খালি।
আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি—সেদিন রাতে আমি লুঙ্গি পরা ছিলাম। ছিদ্দিক আমার একটা ছবি তোলে রোকেয়া হলের সামনে। আমি সেটা রাত ৩টা ৩৮ মিনিটে পোস্ট করি, পুরো দেশকে সত্য দেখানোর জন্য।
এরপর আসে ঐতিহাসিক ৪ আগস্ট যা সবকিছু বদলে দেয়। আসিফ ভাই ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্টে এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন।
৫ আগস্ট আমি এমন কিছু দেখি, যা আজীবন মনে থাকবে। লাখো লাখো স্বাধীনতাকামী মানুষ ভিড় করে টিএসসি ও শাহবাগে। চারপাশ ছিল উৎসবের আনন্দে ভরা। মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিল। যেন ঈদের দিন!
জেনারেল ওয়াকার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন, এমন খবর প্রচার হয়। তখন আমরা বুঝে যাই—হাসিনা শেষ। দুপুর নাগাদ এএফপি-এর বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম ভাই খবরটি ব্রেক করেন: হাসিনা ও তার বোন রেহানা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
ঠিক তখনই, উল্লাসের ঢেউ নেমে আসে জনতার মাঝে। আমরা পায়ে হেঁটে গণভবনের দিকে যাত্রা করি—রাস্তা যেন বিজয়ের উৎসবে মুখর ছিল। আমি জীবনে কখনো মানুষকে এত খুশি দেখিনি।
এরপর আসে ৬ আগস্টের সকাল। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে টিভি চালাই। চোখে পড়ে এক বিস্ময়কর দৃশ্য—বিটিভিতে বাজছে “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে”। সঙ্গে চলছে ছাত্র আন্দোলনের ভিডিও। সেই বিপ্লবের গান, যা একসময় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে অকল্পনীয় ছিল, আজ বিজয়ের সংগীত হয়ে বাজছে।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ পরে, আমি প্রথমবারের মতো গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলি। এরপর আরও দুই ঘণ্টা শান্তিতে ঘুমাই। পুনরায় ঘুম থেকে উঠে, আমি আমার বন্ধুদের দিকে ফিরে বলি সেই বহু কাঙ্ক্ষিত বাক্য—“বন্ধুরা, শুভ সকাল—হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের সকাল থেকে।”
লেখক:
তাওসিফুল ইসলাম
দপ্তর সম্পাদক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি