
সভাপতি নিজে প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন, এমন আগে দেখিনি’- উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন বিসিবি পরিচালক ইফতেখার রহমান। আগের দুই বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান ও ফারুক আহমেদের সঙ্গে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পার্থক্য জানতে চাওয়া হয়েছিল মিডিয়া বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে। উত্তরে তিনি যা বলেছেন, তাতে পরিষ্কার, বিসিবির দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজে নেমে পড়তে একদমই সময় নেননি আমিনুল।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিসিবির ষোড়শ সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির ইতিহাস গড়া আমিনুল। স্বল্প মেয়াদের এই দায়িত্বে পরদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল তার ব্যস্ততা।
আগেই নির্ধারিত ছিল, বোর্ড পরিচালকদের সঙ্গে সভার জন্য শনিবার বিসিবি কার্যালয়ে আসবেন আমিনুল। তাই সকাল থেকেই তার জন্য ছিল সবার অপেক্ষা। দুপুর ১টার পর নতুন পরিচয়ে প্রথম দিন অফিস করতে আসেন বিসিবি সভাপতি।
শুরুতেই ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ, উইমেন'স ক্রিকেট উইং, গেম ডেভেলপমেন্টসহ বিসিবির বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান ও অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন আমিনুল।
মূল কার্যালয় থেকে বেরিয়ে তিনি চলে যান জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি ভবনে। গত কয়েক দিন ধরে চলমান জাতীয় টেস্ট দলের অনুশীলন ক্যাম্পে থাকা ক্রিকেটারদের কয়েকজনের সঙ্গে তখন দেখা হয় নতুন বোর্ড প্রধানের। আইসিসি এলিট প্যানেলে বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার শরফুদৌল্লা ইবনে শহীদের পরিচালনায় 'বিসিবি লিস্ট এ আম্পায়ার্স ওয়ার্কশপ'ও ঘুরে দেখেন আমিনুল।
পরে দুপুর ৩টায় অন্যান্য পরিচালকদের নিয়ে বোর্ড সভায় বসেন তিনি। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টাব্যাপী সভার শুরুতে নিজের কর্মপরিকল্পনা জানিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেন আমিনুল। যেখানে ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে আরও বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেন সাবেক এই অধিনায়ক।
সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে আমিনুলের প্রেজেন্টেশনের বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দেন বিসিবি পরিচালক ইফতেখার।
“খুবই ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে, যে কারণে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা লেগে গেল। প্রথমেই নিজের যত অভিজ্ঞতা আছে, সেসবের আলোকে আমাদের প্রেসিডেন্ট নিজে একটা প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন। তার প্রেজেন্টেশন থেকে আমরা ৪টা প্রোগ্রাম এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছি।”
“প্রোগ্রামগুলোর নাম হচ্ছে- প্রটেক্ট দা স্পিরিট অব দা গেম, হাই পারফরম্যান্স ফর এভ্রিওয়ান, কানেক্ট এন্ড গ্রো এবং ট্রান্সপারেসি এন্ড গুড গভার্নেন্স ইন অল এরিয়া। ক্রিকেট বোর্ডের যে কোনো বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আমরা পূর্ণ চেষ্টা করছি।”
শুধু নিজে প্রেজেন্টেশন দিয়ে কাজ শেষ মনে করেননি বোর্ড সভাপতি। বিসিবির বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির দায়িত্বে থাকা পরিচালকদের নিজ নিজ বিভাগের ও উত্তরণের পথ জানিয়ে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রেজেন্টেশন দিতে বলেছেন আমিনুল।
বিসিবি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে আমিনুল বলেছিলেন, সারা দেশে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়াই হবে তার মূল লক্ষ্য। শনিবারের বোর্ড সভায়ও এটি নিয়েই ছিল মূল আলোচনা।
আপাতত পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ক্রিকেট বিকেন্দ্রীকরণের কাজ শুরু করবে আমিনুলের বোর্ড। কী প্রক্রিয়ায় এটি সম্পন্ন হবে, সেই ব্যাপারে ধারণা দিলেন ইফতেখার।
“অনেক দিন ধরে ঢাকা থেকে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছি আমরা। তাই উত্তরবঙ্গে রাজশাহী এবং ঢাকা-চট্টগ্রামে পাইলট প্রজেক্ট অবিলম্বে শুরু করে দেব আমরা। সেখানে ক্রিকেট বোর্ডের অফিস করে বিকেন্দ্রীকরণের কাজটা করা হবে।”
দ্রুততম সময়ে কাজ শুরু করতে বিসিবি পরিচালক সাইফুল আলম স্বপন চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছে উত্তরের দায়িত্ব। ঢাকা-চট্রগ্রাম নিয়ে করা অংশের দায়িত্ব পেয়েছেন আরেক পরিচালক সালাহউদ্দিন চৌধুরি।
ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার দাবি বাংলাদেশে বেশ পুরোনো। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই নানা সময়ে এটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বোর্ড থেকে।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম ও সিলেটে পরীক্ষামূলকভাবে আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা চালু করেছিল নাজমুল হাসানের বোর্ড। তবে সেটির অগ্রগতি আর দেখা যায়নি।
নতুন করে আবার বিকেন্দ্রীকরণের আলোচনায় তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এটি কি আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাই নতুন করে শুরুর প্রক্রিয়া কি না। দুটির পার্থক্য তুলে ধরেন বিসিবির মিডিয়া বিভাগের প্রধান।
“আমরা এটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে নিয়েছি। কারণ এতে আমাদের অভিজ্ঞতা কম। এখন আমরা অবিলম্বে বিকেন্দ্রীকরণ করে দুটি অংশ দুজন পরিচালককে দিচ্ছি। আমরা যে বলি না, মিনি বিসিবি? ওরকম মিনি বিসিবিই হবে ওসব জায়গায়। এখন ঢাকা থেকেই সারা দেশের স্কুল ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা আসলে শুধু জাতীয় পর্যায়ে আসার পর বিসিবির দেখা উচিত।”
“এই ধরনের কাজগুলোই এখন ওই দুই জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। বিস্তারিত পরিকল্পনা করছি আমরা। এমন না যে আগের সব বাদ করে দিচ্ছি। আগের পরিকল্পনার সঙ্গে নতুন সভাপতির ভাবনার মিশেলে আমরা এগিয়ে যেতে চাচ্ছি।”
ইফতেখার জানান, বোর্ড সভায় বিপিএলের রাজস্ব আয় নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সদ্য বিদায়ী সভাপতি ফারুক আহমেদ বেশ কয়েকবার বলেছেন, সবশেষ আসরের টিকেট বিক্রি থেকে ১৩ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে বিসিবি। তবে সেই তথ্যে কিছুটা ফাঁকফোকর ছিল বললেন ইফতেখার।
সব খরচ বাদ দিয়ে টিকেট বিক্রির আয় এবং সব মিলিয়ে বিপিএল থেকে কত রাজস্ব এলো, সেই ধারণা দেন বিসিবির এই পরিচালক।
“টিকেট বিক্রি থেকে ১২ কোটি ৩৪ লাখ ৯০০ টাকা রাজস্ব এসেছে। টিকেট বিক্রির কাজে সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং বিপিএলে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে রাজস্ব শেয়ারিংয়ের খরচ বাদ দিয়ে আমাদের টিকেট বিক্রি থেকে নেট লাভ এসেছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।”
তবে এটি এবারের বিপিএল থেকে বিসিবির মোট লাভ নয়। বরং ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি, টিভি স্বত্ব এবং অন্যান্য স্পন্সরশিপ স্বত্ব থেকে বোর্ডের পাওনা আছে ২১ কোটি টাকার বেশি। ইফতেখার জানান, এসব টাকা আদায় করতে পারলে সবশেষ বিপিএল থেকে বিসিবির লাভ হবে ৭৫ লাখ টাকা।
কিন্তু বিগত বছরগুলোতে অনেকবারই দেখা গেছে, এসব পাওনা আর তুলতে পারে না বিসিবি। অনেক সময় নিজেদের তহবিল থেকেই দেওয়া হয় ভর্তুকি। আবার কখনও ভারী হতে থাকে বাকির খাতা।
তাহলে এবারের বিপিএল কি অলাভজনক ছিল বিসিবির? জবাবে পাওনা আদায়ের ব্যাপারে আশার কথা বলেন ইফতেখার।
“যদি পাওনা টাকাগুলো না পাই, তাহলে অবশ্যই অলাভজনক ছিল। আবার বলছি, যদি টাকা না পাই। যে টাকাটা পাওনা আছে, সেগুলো আমরা চাইব তাদের কাছে। সেটা পাওয়ার পরে আবার... হিসেবটা হচ্ছে, সব টাকা পেলে ৭৫ লাখ টাকা লাভ হবে আমাদের।”
দেশের ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণ, বিপিএলের বাইরে বোর্ড সভায় প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বিসিবির মানবসম্পদ বিভাগ নতুন করে সাজানোর জন্য এখন মানবসম্পদ পরামর্শকও নেওয়া হবে।
আম্পায়ারদের ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাইজেশন প্রোগ্রামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সভায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) সামনের আসর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আগামী সেপ্টেম্বরে। এছাড়া টবি লামসডেনের তত্ত্বাবধানে একটি কিউরেটর কোর্সের আয়োজন করবে বিসিবি।