
কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জেরে যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। এ যুদ্ধে এখনো নানা প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। পেহেলগামে হামলার পর ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে (এলওসি) ৯টি স্থাপনায় হামলা চালায়। এসব স্থাপনাকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য বলে দাবি করে আসছে। কিন্তু এ হামলার পরও অধরা রয়ে গেছে কথিত জঙ্গিরা। তাহলে কেন এ যুদ্ধ?
দুই দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্ধৃদি দিয়ে ‘পাকিস্তান টাইমস’ এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ভারতের হামলার পর সীমান্তের ওপার থেকে ড্রোন হামলা চালায় পাকিস্তান। এই সংঘর্ষ চলাকালীন এবং তার পরেও উভরপক্ষের বহু দাবি জানানো হয়েছে, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগও উঠেছে। এর মধ্যে কিছু দাবি যাচাই করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগই এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
এছাড়া অনেক সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। এমন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর প্রতিরক্ষা, কূটনীতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছে পাকিস্তান টাইমস।
পুলিশ জানিয়েছে, পেহেলগামে হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে চিহ্নিত করেছিল জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন কাশ্মীরি ও দুজন পাকিস্তানি ছিলেন। তাদের বিষয়ে তথ্য দিলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, সন্ত্রাসীরা আমাদের বোনেদের সিঁদুর মুছে দিয়েছে। তাই ভারত এই সন্ত্রাসের সদর দপ্তরই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ হামলায় শতাধিক সন্ত্রাসী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ভারত। সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) জীবন রাজপুরোহিত জানান, এই সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা কঠিন। কারণ, তাদের চারপাশে স্থানীয় সমর্থকদের একটা নেটওয়ার্ক রয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা পাকিস্তানের কাছ থেকে সাহায্য পায়।
তিনি বলেন, এই দুটি কারণে ভারতের জন্য সন্ত্রাসবাদকে একেবারে গোড়া থেকে উৎখাত করা জরুরি। সন্ত্রাসবাদ একটা কাঠামো। তাই সন্ত্রাসবাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে হলে শুধু সন্ত্রাসীদের হত্যা করাই যথেষ্ট নয়, বরং যে কাঠামো এটা পরিচালনা করে সেটা গুঁড়িয়ে ফেলা দরকার। কেবল কয়েকজন সন্ত্রাসীকে নিধন করে এই সমস্যার মূল উৎপাটন করা সম্ভব নয়।
আন্তঃসীমান্ত হামলায় বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তাকর্মীদের মৃত্যু হয়েছে। বিবিসিসহ একাধিক গণমাধ্যম নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বললেও ভারত সরকার এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি।
এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, সীমান্তে গোলাগুলির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কেন সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়নি?
এই প্রশ্নের জবাবে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল দীপ্তেন্দু চৌধুরী জানিয়েছেন, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নির্দিষ্ট প্রোটোকল রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব নির্দেশিকা আছে। কাশ্মীরের সীমান্ত এলাকায় জনসংখ্যা তুলনামূলক কম, জম্মুতে বেশি, এবং পাঞ্জাবে সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষ এর আগেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। বহু বছর ধরে তারা গোলাগুলির সম্মুখীন। তারা এর জন্য প্রস্তুত থাকেন। সেখানে বাংকার ও অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। সাইরেন বাজলে বা ব্ল্যাকআউট হলে তারা জানেন কী করতে হবে।
এ কারণে ভারত সরকার নতুন করে স্থানান্তরের নির্দেশনা জারির প্রয়োজন মনে করেনি। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন, যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়লে বা সেনা মোতায়েন বৃদ্ধি পেলে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় এবং এর জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে হঠাৎ গোলাগুলির কারণে আগাম সতর্কতা জারি করা সম্ভব হয়নি।
পাম্পোরে ধাতব টুকরো ও পাকিস্তানের দাবি জম্মু ও কাশ্মীরের পাম্পোরে একটি বৃহৎ ধাতব টুকরো পাওয়া গেছে, তবে ভারত সরকার এটি কোনো ভারতীয় বিমানের অংশ কিনা তা নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি। অন্যদিকে, পাকিস্তান দাবি করেছে যে তারা ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল একে ভারতী বলেছেন, আমরা যুদ্ধের পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি, এবং ক্ষয়ক্ষতি এরই অংশ। প্রশ্ন হওয়া উচিত, আমরা কি আমাদের লক্ষ্য অর্জন করেছি? আমরা কি সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করতে পেরেছি? উত্তর হলো—হ্যাঁ।
তিনি আরও বলেন, বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, কারণ এতে শত্রুপক্ষ লাভবান হতে পারে। তবে আমি বলতে পারি, আমাদের সব পাইলট নিরাপদে ফিরেছেন।
পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ভূখণ্ডে তাদের বিমান প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ আমাদের কাছে নেই।
ক্ষয়ক্ষতি প্রকাশে ভিন্ন মত এয়ার মার্শাল দীপ্তেন্দু চৌধুরী বলেন, কোনো অভিযানে ক্ষয়ক্ষতির বিষয় প্রকাশ্যে জানানোর ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। তিনি বালাকোট অভিযানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা অভিযানের সাফল্য নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে প্রস্তুত ছিলাম না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথ্য দিচ্ছিল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরে এসেছিল। কিন্তু ততক্ষণে ন্যারেটিভ বদলে গিয়েছিল। পাইলট অভিনন্দন বর্তমান ধরা পড়ায় বিশ্বের মনোযোগ অন্যদিকে চলে যায়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কৌশলগত উদ্দেশ্য ম্লান হয়ে যায়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ক্ষয়ক্ষতি সেনাবাহিনীর কাজের অংশ। কে কতগুলো বিমান ভূপাতিত করেছে, তা বড় বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছি? লোকসান হবেই, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনই মুখ্য।
যুদ্ধবিরতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, তার মধ্যস্থতায় দুই দেশ সংঘাত বন্ধে সম্মত হয়েছে। ভারত বলছে, পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) এর উদ্যোগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক দিলীপ সিং বলেন, সম্ভবত পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কথা বলে। ভারত বলেছে, আমরা প্রস্তুত, তবে উদ্যোগটা পাকিস্তানের হতে হবে। এরপর পাকিস্তান তাদের ডিজিএমও-র মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
তিনি যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক শুধু ট্রাম্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
বিরোধীদের প্রশ্ন ও সরকারের দায়বদ্ধতা যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর বিরোধী রাজনীতিবিদরা সরকারের কাছে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল। তারা সামরিক অভিযানে বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজনীয়তাও উত্থাপন করেছেন।
দিলীপ সিং বলেন, সামরিক অভিযানে বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ কোনো প্রোটোকলের অংশ নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গোপনীয় তথ্যের ভিত্তিতে নেওয়া হয়। বিস্তারিত প্রকাশ করলে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক চন্দ্রচূড় সিং বলেন, সামরিক নীতি নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শের কোনো নজির নেই। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও এমন আলোচনা হয়নি। সংসদীয় ব্যবস্থায় সামরিক সিদ্ধান্ত সংসদে আনা হয় না। এই সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হয় যাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ও অভিযানের বিবরণ থাকে।