
তোতলামি সারানোর চিকিৎসকও কখনো কখনো তোতলা হতে পারেন। তখন তোতলামি সারাতে সেই চিকিৎসককে যেতে হয় অন্য চিকিৎসকের কাছে। প্রফেসর জেমস ক্যাল্ডারের অবস্থাও খুব একটা আলাদা নয়। পা ও গোড়ালির (অ্যাঙ্কেল) অস্ত্রোপচারে বিশেষজ্ঞ ক্যাল্ডার। দ্য টাইমসের প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার এক সপ্তাহ আগেই এক সতীর্থ চিকিৎসকের মাধ্যমে হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করান ক্যাল্ডার।
সেই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ক্যাল্ডারের হাঁটাচলা স্বাভাবিকই ছিল। খোঁড়াতে দেখা যায়নি। ক্যাল্ডার নিজেই জানালেন তাঁর বর্তমান পরিস্থিতি, ‘অস্ত্রোপচার করানোর আগে এবং করানোর এক দিন পর যেমন ছিলাম, এখন তার চেয়ে ভালোভাবে হাঁটু ভাঁজ করতে পারছি।’
মজা করে কেউ কেউ বলতে পারেন, চিকিৎসকের নিজেরই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে তাঁর রোগীদের না জানি কী অবস্থা!
না। ক্রীড়াবিদদের কাছে ক্যাল্ডার খুব জনপ্রিয় অর্থোপেডিকস চিকিৎসক। বিশ্বসেরা সার্জন ও দ্রুত সেরে ওঠার প্রয়োজন হলে ক্রীড়াবিদেরা ভিড় জমান মধ্য লন্ডনে ক্যাল্ডারের প্রতিষ্ঠা করা ফোর্টিয়াস ক্লিনিকে। এই ক্লিনিকের তিনি সহপ্রতিষ্ঠাতা। ক্লিনিকে ঢোকার পথে হলরুমে নেইমার ও ভার্জিল ফন ডাইকের সই করা দুটি জার্সি ফ্রেমে বাঁধাই করে ঝুলিয়ে রাখা। চোটের কারণে কিছুদিন আগে শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খেলতে না পারা বাংলাদেশের পেসার তাসকিন আহমেদও ক্যাল্ডারকে দেখিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকে অ্যাকিলিস টেনডিনোপ্যাথিতে ভোগা তাসকিন গত মাসের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে যান। গত ২৯ এপ্রিল ক্যাল্ডারের সঙ্গে তাঁর দেখা করার দিন-তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। ক্যাল্ডারকে নিয়ে তখন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ওই চিকিৎসক একজন বিশেষজ্ঞ গোড়ালির সার্জন। আমরা নিজেরাও যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়েছি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। সব দিক বিবেচনায় আমরা সেরা বিকল্পটাই বেছে নিয়েছি।’

লন্ডন হসপিটাল মেডিকেল কলেজ থেকে থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে অ্যাঙ্কেল ম্যানেজমেন্টের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি নেন ক্যাল্ডার। খেলাধুলাজনিত চোটের চিকিৎসা করে পরিচিতি পান আয়ারল্যান্ডে। লন্ডন ইমপেরিয়াল কলেজে বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসরও তিনি।
দ্য টাইমসের প্রতিবেদক যখন ক্যাল্ডারের সঙ্গে দেখা করেন, তখন ক্লিনিকটির ভিভিআইপি ফ্লোরে জার্মানি জাতীয় দলের এক ফুটবলার তাঁর দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ক্যাল্ডার অবশ্য সে ফুটবলারের নাম উল্লেখ করেননি।
শুধু ক্রীড়াবিদেরাই নন, অন্যান্য জগতের সেলিব্রিটিরাও ধরনা দেন তাঁর কাছে। ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের সিনেমা প্রযোজনা করে খ্যাতি পাওয়া বারবারা ব্রোকোল্লি যোগাযোগ করেছেন তাঁর সঙ্গে। কারণ? ২০২১ সালে তাঁর সহপ্রযোজনায় মুক্তি পাওয়া ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের সিনেমা ‘নো টাইম টু ডাই’–এর মূল চরিত্রে অভিনয় করা ড্যানিয়েল ক্রেগের পা ভেঙে গিয়েছিল। ক্যাল্ডার ক্রেগকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। নির্ভানা ব্যান্ডের সাবেক ড্রামার ডেভ গ্রোলও অস্ত্রোপচার করিয়েছেন ক্যাল্ডারের কাছে।

ক্যাল্ডার জানিয়েছেন, খেলাধুলার বাইরে অন্য ভুবনের তারকাদের সময়মতো চিকিৎসা দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অত্যধিক ব্যস্ততায় তাঁদের সময়ের বড় অভাব। ক্যাল্ডারের ভাষায়, একটু এদিক-সেদিক হওয়া মানে ‘লাখ লাখ ডলার লোকসান দেওয়া’।
দুই দশক আগেও ক্রীড়া বিশ্বের তারকাদের অস্ত্রোপচার করাতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়াটা ছিল ফ্যাশন। কিন্তু সময় পাল্টেছে। শুধু ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকেই খেলোয়াড়েরা ক্যাল্ডারের কাছে যান না, যুক্তরাস্ট্র থেকেও ক্রীড়াবিদেরা যান তাঁর কাছে, যদিও যুক্তরাস্ট্রের বেশির ভাগ দলের স্পনসরের সঙ্গে স্বাস্থ্যগত সুবিধা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোরও সংশ্লিষ্টতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাস্কেটবল কিংবদন্তি কেভিন ডুরান্ট ব্রুকলিন নেটসে থাকতে তাঁর চোটের দেখাশোনা করেছেন ক্যাল্ডার।

তারকা ফুটবলারদের ক্ষেত্রে দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য সেরা চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তাড়াহুড়া করে মাঠে ফিরে খেলোয়াড় একই সমস্যায় আবারও পড়ুক, সেটা কোনো ক্লাবই চায় না। ক্যাল্ডার এ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন, ‘কোনো কিছুই শতভাগ নিশ্চিত নয়। দুজন রাগবি খেলোয়াড় এবং এক ফুটবলার তাদের একিলিস টেন্ডনে চোট পেয়ে আমার কাছে এসেছিল। যেটা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। কারণ, তারা ভেবেছে, এটা কীভাবে হলো, আসলে কখনো কখনো এসব কোনো কারণ ছাড়াই হতে পারে।’
ক্যাল্ডার জানেন, ফুটবল ছাড়াও অন্যান্য খেলায় এখন ম্যাচসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতাও বেড়েছে। একটি অবাক করা তথ্যও জানিয়েছেন তিনি, ‘ফুটবলে কোচ পাল্টানো হলে চোট (খেলোয়াড়দের) বাড়ে। সেটা সামান্য টিস্যুর চোটও হতে পারে, যেমন হ্যামস্ট্রিং। তবে এমন চোটে ঝামেলা বাড়ে দলগুলোর। কারণ, অন্য কাউকে শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়।’
ক্যাল্ডার এ নিয়ে বলেছেন, ‘প্রিমিয়ার লিগে বড় একটি ক্লাবের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে কথা হয়েছে। ক্লাবগুলো এ বিষয়ে ভালোভাবেই জানে। কিন্তু এটা সামলানো কঠিন। কারণ, নতুন কোচদের শুরুতেই নিজের কাজের একটা ছাপ রাখতে হয় এবং সেটার জন্য খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতাও বাড়ে।’