
প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩২ সনেও দেশের ক্রীড়া, অভিনয়, গবেষণা, স্থাপত্যসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে দুই পাতার আয়োজন থেকে পড়ুন ক্রিকেটার নাহিদ রানার গল্প।
‘গোল্ড, পিওর গোল্ড’…নাহিদ রানাকে নিয়ে লিখতে বসে ড্যানি মরিসনের কথাটা বারবার কানে বাজছে। গোল্ড, পিওর গোল্ড…।
ড্যানি মরিসনকে কি পরিচয় করিয়ে দিতে হবে? সাবেক কিউই পেস বোলার। ৪৮টি টেস্ট খেলেছেন, ৯৮টি ওয়ানডে। তবে তরুণ ক্রিকেট অনুসারীদের কাছে তিনি কথায় কথায় মজা করা এক ধারাভাষ্যকার। বলে ভালোই গতি ছিল, তবে যে সীমানাটা পেরোলে ফাস্ট বোলার বলা যায়, সেই লক্ষ্মণরেখা পেরোতে পারেননি। এ কারণেই হয়তো নাহিদ রানার মহিমাটা ড্যানি মরিসন আরও ভালো বোঝেন। নাহিদ রানা সম্পর্কে বলেন, ‘গোল্ড, পিওর গোল্ড।’
ক্রিকেটে এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলাররা আসলেই তা–ই। ‘এক্সপ্রেস’ কথাটা খেয়াল করতে বলি। বলের গতি ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার পেরোলেই তাঁকে আপনি ফাস্ট বোলার বলে ফেলতে পারেন। তবে এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলার বলতে হলে অন্তত ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতি চাই। এমন না যে, এটার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আছে, ‘একজন বোলার ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করিলে তাহাকে এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলার বলা হইবে।’ এসব পরিভাষা মুখে মুখে হয়েছে। তা এই এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলারদের বলতে পারেন ক্রিকেটের সবচেয়ে অমূল্য রত্ন। চেষ্টাচরিত্র করে কারও বলের গতি হয়তো একটু বাড়ানো যায়, কিন্তু এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলার তৈরি করা যায় না। এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলাররা গতির ঝড় তোলার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে জন্মান।

নাহিদ রানাকে নিয়ে লিখতে বসে ‘ফাস্ট বোলিং কাহাকে বলে এবং উহা কত প্রকার ও কী কী’ টাইপ রচনা ফেঁদে বসায় বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু উপায় নেই। কারণ, নাহিদ রানার অনন্যতা ওই গতিতেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ১৪০ কিলোমিটারের বোলার বেশ কজনই এসেছেন, এখনো আছেন। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ১৪৫ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বোলিং করে প্রায়ই সেটিকে ১৫০ কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই করে ফেলা বোলার এর আগে কখনো আসেনি। বাংলাদেশের পটভূমিতে নাহিদ রানা তাই হয়তো ‘গোল্ড, পিওর গোল্ড’–এর চেয়েও বেশি।
বলে বেশি গতি থাকার একটা বিপদও আছে। গতির নেশা বিষম নেশা, সেই নেশায় লাইন–লেংথের কথা অনেক সময় মনে থাকে না। শুরুতে নাহিদ রানারও এই সমস্যা ছিল। গত বছর মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে বলের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁর রান বিলানো। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫ উইকেট, তবে বিনিময়মূল্যটা ছিল বড় চড়া। রান দিয়েছিলেন ওভারে প্রায় সোয়া ৬ করে। ক্রিকেট ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ফাস্ট বোলার উৎপাদন করা ওয়েস্ট ইন্ডিজে এ ধরনের বোলারদের একটা নাম আছে—ডা ওয়াইল্ড থিং! এখানে ‘ডা’ মানে ‘দ্য’। ওয়াইল্ড থিং মানে তো বুঝতেই পারছেন। বল কোথায় যাবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
সিলেটে জীবনের প্রথম টেস্টে নাহিদ রানা ছিলেন সেই ‘ডা ওয়াইল্ড থিং’। মাস পাঁচেক পর পাকিস্তান সফরের প্রথম টেস্টেও। প্রথম ইনিংসে উইকেট তো পানইনি, ১৯ ওভারে রান দিয়েছিলেন ১০৫। সেখান থেকে নাহিদ রানার প্রত্যাবর্তনটা তাঁর বলের গতির মতোই চোখধাঁধানো। পাকিস্তানেই পরের টেস্টে গতির সঙ্গে লাইন–লেংথের বিবাদভঞ্জন, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৪ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের জয়েও বড় ভূমিকা তাঁর।
যে পাকিস্তান থেকে নানা সময়ে ‘বিশ্বের দ্রুততম বোলার’ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এসেছে, সেই পাকিস্তানে বাইরের কোনো ফাস্ট বোলার গতির ঝড় তুললে তাতে আলাদা একটা মাত্রা যোগ হয়। তার ওপর দুই দল মিলিয়েই ওই সিরিজের আলোচিত বোলার ছিলেন নাহিদ রানা। সেটিও কোথায়—তর্কযোগ্যভাবে ইতিহাসেরই সবচেয়ে ভীতিকর ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতারের শহর রাওয়ালপিন্ডিতে।
মাস দুয়েকের মধ্যে জ্যামাইকার কিংস্টনে এর চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন নাহিদ রানা। শোয়েবের কারণে পিন্ডি বিখ্যাত হতে পারে, কিন্তু ফাস্ট বোলিংয়ের কথা বললে জ্যামাইকার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না। কিংবদন্তি সব ফাস্ট বোলারের দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে গতিময় বোলিং নিয়ে যত কীর্তিগাথা, যত গল্প, তার প্রায় সবই হয় বারবাডোজের কেনসিংটন ওভালে, নয়তো কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে।

এর মধ্যে স্যাবাইনা পার্ক একটু এগিয়ে দর্শক–উন্মাদনার কারণে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগে দলে যখন ফাস্ট বোলারের মিছিল, স্যাবাইনা পার্কের গ্যালারি থেকে ‘কিল হিম’ ‘কিল হিম’ চিৎকার উঠত। গতি আর বাউন্সারে বিপর্যস্ত ব্যাটসম্যানকে দেখাই ছিল তাঁদের সবচেয়ে বড় আনন্দ। গত নভেম্বরে স্যাবাইনা পার্কের দর্শক আবারও তা দেখেছে, তবে পার্থক্য বলতে এবার বিপর্যস্ত–টালমাটাল ব্যাটসম্যানরা সব তাদের নিজেদের দলের! বোলারের নাম? নাহিদ রানা।
ব্যাটসম্যানদের জন্য প্রথম সেঞ্চুরি যেমন চিরস্মরণীয়, বোলারদের জন্য প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেটও তা–ই। স্যাবাইনা পার্কে সেই পরম আরাধ্যের সঙ্গে নাহিদ রানার প্রথম দেখা। তবে স্যাবাইনা পার্কের নাহিদ রানা শুধু এ কারণেই মনে থাকবেন না। বাংলাদেশ টেস্টটা জিতেছিল, এ কারণেও নয়। আজ থেকে অনেক দিন পর নাহিদ রানাকে নিয়ে যখন কথা হবে, সবাই ফিরে তাকাবেন ওই টেস্টে। যখন সত্যিকার এক বিশ্বতারকা হিসেবে আবির্ভাবের সম্ভাবনা তারস্বরে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক ফাস্ট বোলার।
স্যাবাইনা পার্কের রোমাঞ্চকর ইতিহাস নাহিদ রানা হয়তো জানেনও না। তবে যাঁরা জানেন, তাঁরা হয়তো ঠিকই মিলিয়ে নেবেন। ফাস্ট বোলারদের মৃগয়াভূমিতেই বাংলাদেশের প্রথম এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলারকে ক্রিকেট–বিশ্বের সেভাবে প্রথম চেনা।
একটু কি বেশি বলা হয়ে যাচ্ছে? ক্যারিয়ারের উষালগ্নে থাকা এক বোলার, ৭ টেস্টে যাঁর ২৩ উইকেট। তার ওপর ফাস্ট বোলারদের পথ বড় বিপৎসংকুল। বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে চোট–আঘাতের অ্যাম্বুশ। শুরুটা না হয় ভালো হয়েছে, কিন্তু পূর্ণেন্দু পত্রী কি লিখে যাননি, ‘আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়/ আরম্ভে সকল গাছই সুস্বাস্থ্য সবুজ।’
সেই ‘সবুজ’–এর ক্রমে ‘হরিদ্রাভ’ হওয়ার আশঙ্কার কথাও ওই কবিতাতেই আছে। সেই শঙ্কাকে তুড়ি মেরে নাহিদ রানা কি পারবেন সবুজ থেকে সবুজতর হয়ে উঠতে?
প্রশ্নটা তো সহজ নয়ই, উত্তরও নেই জানা। আমরা বরং মাত্র শুরু হওয়া নাহিদ রানার গল্পের বাকিটুকুর জন্য রোমাঞ্চভরে অপেক্ষা করি।
উৎপল শুভ্র: প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক