একে তো অস্পষ্ট নীতিমালা, তার ওপর নীতিমালায় ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে ফাইভজি সেবার কোনো কূল-কিনারা মিলছে না। এর ওপর টেলিকম নেটওয়ার্কে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের সীমাহীন দাপট। সব মিলে লেজে-গোবরে অবস্থা
আচ্ছা, ওই ডিভাইসটিকে আপনি কী বলবেন—যাতে রয়েছে একটি সুদৃশ্য স্ক্রিন, একটি পরিমিত কি-বোর্ড, কন্টাক্ট, ই-মেইল আর ডকুমেন্টের মতো ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের জম্পেশ স্টোরেজ, আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় অডিও-ভিডিও ফাইল খোলার চৌকস সামর্থ্য, গেমস আর স্প্রেডশিট প্রগ্রাম, রয়েছে যোগাযোগের অনন্য উপাদান। উত্তরটি অনেকের জিভের ডগায় লাফাবে। একনিঃশ্বাসে হয়তো কেউ কেউ বলবেন, কেন কম্পিউটার! না জনাব, হিসাবে ভুল হচ্ছে। কারণ ওটি ফাইভজি মোবাইল ফোন।
বাংলাদেশে ফাইভজি সেবা কবে চালু হবে, তার সুস্পষ্ট কোনো জবাব নেই খোদ বিটিআরসির কাছেও। অথচ মোবাইল ইন্টারনেটের ফাইভজি সেবা চালু করতে ২০২২ সালের মার্চে তরঙ্গ বরাদ্দের নিলাম হয়; নীতিমালা হয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
মোবাইল ফোনকে প্রযুক্তিবিদরা অনেক আগেই ‘ব্যক্তিগত সচিব’-এর মর্যাদা দিয়েছেন। তাহলে ফাইভজিকে কী বলা যায়? এই প্রযুক্তি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়ে আমাদের জীবনবোধ পাল্টে দিতে পারে।
অর্থনৈতিক দিক ও বাস্তবতার দিক থেকে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ইন্টারনেট আরো ছড়িয়ে দিতে ফাইভজিই হতে পারে সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রযুক্তি। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে, যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের টিকিট, টাকার লেনদেন, উকিল নোটিশ ফাইভজির বাটনে টিপেই সারতে পারছে বলে ডিজুস প্রজন্ম ফাইভজি প্রযুক্তিকে রাতদিন পেন্নাম জানাচ্ছে।
টেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জটিল ও অত্যাধুনিক বেশ কিছু কাজে হয়তো পিসি আর ল্যাপটপ থেকেই যাবে। কারণ একজন আর্কিটেক্ট যদি ডিজাইন প্রগ্রাম চালাতে চান, তাহলে পিসিই হবে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যদি নতুন ধরনের সার্কিটের ডিজাইন তৈরি করতে চান, তাহলে তিনি পিসিকেই প্রাধান্য দেবেন। ফিল্ম মেকার যদি ভিডিও এডিট করতে চান, তাহলে পিসিই গ্রেট! কিন্তু বর্তমানে হাতের তালুতে ঠাঁই পাওয়া ফাইভজি ফোনকে চোখ রাঙানোর ক্ষমতা যে কম্পিউটার দিন দিন হারিয়ে ফেলছে!
মোবাইল ফোনের বিবর্তন কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ফাইভজি নিজেই কম্পিউটার হয়ে উঠেছে। আসলে প্রযুক্তির সুপার-সড়কে মেধা ও মননের জম্পেশ মিলনে গড়ে উঠছে যোগাযোগের নন্দিত জীবনবোধ। ফাইভজি ফোনের ‘জীবনঘনিষ্ঠতা’ এখানেই। প্রযুক্তির অফুরান সম্ভাবনার সব কটি দরজা খুলে দিয়েছে এটি। প্রযুক্তিবিদরা এই গ্রহবাসীর সামনে প্রমাণ করতে পেরেছেন, আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় নিমেষেই সজীব হয়ে ওঠা একটি খুদে ডিভাইসও জীবনবোধের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
২০১৯ সালের দিকে সারা বিশ্বে ফাইভজি নেটওয়ার্ক শুরু হয়। ২০২১-২২ সালের মধ্যে এর প্রসার ঘটে। জিএসএমএ ধারণা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ফাইভজি নেটওয়ার্কে এলে তা মোবাইল ফোন শিল্প ও গ্রাহকদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বাংলাদেশে টেলিকম রেগুলেটরে নীতিমালা তৈরিতে ধীরগতি এবং অপারেটরদের অনীহা ও প্রস্তুতির অভাব দেশে ফাইভজি চালুর বিষয়টি এখনো দূরবর্তী বিষয় হয়ে রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারকসহ সব অংশীদারের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বিশেষ কমিটিকে ফাইভজি নীতিমালার খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাতে ২০২২ বা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেশে ফাইভজি চালু করা যায়। কিন্তু ‘অস্পষ্ট’ যুক্তিতে ফাইভজি সেবা এখনো ঝুলছে। ২০২২ সালের ৩১ মার্চ দেশের চার মোবাইল ফোন অপারেটর ১.২৩ বিলিয়ন ডলারে ১৯০ মেগাহার্জ তরঙ্গ কিনেছিল। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সে বছর নির্দেশিকা জারিতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ফাইভজি তরঙ্গ নিলামের প্রায় দুই বছর পর এবং নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরুর চার বছরের বেশি সময় পর ২০২৪ সালে লাইসেন্সের নীতিমালা জারি করে বিটিআরসি। তবে নির্দেশিকাটি ফাইভজি চালুর বাধ্যবাধকতার স্পষ্ট রূপরেখা দিতে ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি ফাইভজি চালুর বিরুদ্ধে সব অপারেটরের শক্ত অবস্থানের প্রেক্ষাপটে নীতিমালার শিরোনাম থেকেও বাদ যায় ‘ফাইভজি’ শব্দটি।
অপারেটররা বলে, উচ্চ অবকাঠামো খরচ, গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা ও বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় ফাইভজি চালু আর্থিকভাবে কার্যকর নয়। বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি মোবাইল গ্রাহক ফোরজি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। বাজার তৈরি না হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে চালু করা যাচ্ছে না ফাইভজি। ফলে বাজার তৈরির জন্য অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। আর সেই বাজার কবে নাগাদ তৈরি হতে পারে, সেটি কেউ জানে না।