Image description
 

মসজিদের খতিব থেকে ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণ আর হয়রানি ও নির্যাতন ছিল পতিত আওয়ামী সরকারের অন্যতম কৌশল। শুধু খুতবা আর ওয়াজের কারণে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের শিকার হন দেশের অন্যতম ধর্মীয় আলোচক ও খতিব হাফেজ মাওলানা মীর্জা ইয়াসিন আরাফাত। ধর্মচর্চার নামে বিকৃতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল হত্যা মামলা।

আর ওয়াজ মাহফিলে সরকারের অপছন্দের কিছু কথা বলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ দুই মাস তাকে কাটাতে হয় জেলে। জজ কোর্টে জামিনের আবেদনে মেলেনি জামিন। হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পরও কাগজ আটকে মুক্তিতে বিলম্ব করা হয়। মাহফিল বন্ধ বা দাওয়াত বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে অনেক।

এসব নির্যাতন ও নিপীড়ন প্রসঙ্গে মাওলানা মীর্জা ইয়াসীন আরাফাত আমার দেশকে বলেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অধিকাংশ বিরোধী মতের মানুষ, যারা রাজপথে মাঠে-ময়দানে কথা বলেছেন অথবা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের সুযোগমতো নানা প্রক্রিয়ায় নির্যাতন করা হয়েছে। কখনো মামলা দিয়ে, কখনো হুমকি অথবা গ্রেপ্তার ও জেলে নিয়ে এই নির্যাতন করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলেম-ওলামা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

মাওলানা ইয়াসীন আরাফাত বলেন, প্রতিটি মাহফিলেই ইনসাফের কথা, জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন তিনি। ২০২২ সালে ফরিদপুরের কানাইপুরে একটি মাহফিলে প্রধান আলোচক ছিলেন আবু ত্বহা আদনান। বিশেষ অতিথি ছিলেন তিনি। সেই মাহফিলে বাধা দেয় আওয়ামী সরকারের লোকরা।

সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনোভাবেই একটি রাষ্ট্র পুলিশের ভয় দেখিয়ে, আইনশৃঙ্খলার ভয় দেখিয়ে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে মানুষের ওপর চেপে বসেছে- এভাবে কখনো কোনো মানুষকে কন্ট্রোল করা যায় না, যদি আল্লাহর ভয় মানুষের অন্তরে না থাকে। আল্লাহর ভয় থাকলে মানুষ বিভিন্ন অপরাধ থেকে বেঁচে থাকে। কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব ও আইনের ভয় দেখিয়ে মানুষকে কন্ট্রোল করা যায় না। তাই আমি সরকারের প্রতি আবেদন করব- তিনি যেন ওয়াজ মাহফিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করেন, অনুমতির প্রয়োজন যেন না হয়।’

এই বক্তব্যের পরই ফরিদপুর সদর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মাওলানা ইয়াসীন আরাফাতের নামে মামলা করে পুলিশ। এরপরই বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতেও তিনি কিছু মাহফিল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের একটি জামিন আদেশ পান তিনি।

একই সঙ্গে ফরিদপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করার কথা বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৪ মার্চ ফরিদপুর আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে শুনানি শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়। সেই আদেশ অনুযায়ী তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এর আগেও মামলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাতে কারাগারে যেতে হয়নি। সেবারই প্রথম কারাগারে যান তিনি। কারাগারে নেওয়ার আগে আদালতের গারদে রাখা হয়েছিল মীর্জা ইয়াসীন আরাফাতকে। সেখানে তেমন পরিবেশ না থাকলেও নামাজ পড়ে কিছু খাবার খান তিনি। কারাগারে নেওয়ার প্রস্তুতিকালে পুলিশের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়।

কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, তার গ্রেপ্তারের খবরটি ফেসবুকে প্রচার হয়ে যাওয়ায় মিছিল-মিটিংয়ের আশঙ্কা করছিলেন তারা। এ জন্য ঢাকা থেকে তাকে সতর্কতার সঙ্গে দ্রুত কারাগারে পাঠাতে বলা হয়। একপর্যায়ে প্রিজনভ্যানে তুলে ফরিদপুর কারাগারে নেওয়া হয় তাকে। সম্পূর্ণ বিনা কারণে মামলা ও কারাভোগ করতে হয় এই আলেমকে।

কারাগারে থাকা অবস্থায় জামিনের জন্য জজ কোর্টে তিন দফায় আবেদন ও শুনানি করলেও জামিন দেওয়া হয়নি। এমনকি হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার পরও মুক্তি পেতে ১৭ দিন অপেক্ষা করতে হয় তাকে। কারণ জামিন আদেশের পরও তার কাগজ দেওয়া হচ্ছিল না। কারণ বিচারপতি মানিকের একটি শ্বেতপত্রে তার নাম ঢোকানো হয়েছিল।

এ জন্য জামিনের কাগজ দিতে গড়িমসি করা হয়। অনেক দেনদরবার করে সেই কাগজ নিতে হয় তাকে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তারদের কোনোভাবেই যেন জামিন না দেওয়া হয়, সে জন্য ওপর থেকে নির্দেশনা ছিল তিনি জানতে পারেন। বিশেষ করে জেলা কোর্টগুলোকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এটার শিকার তিনিসহ সব আলেম।

মাওলানা ইয়াসীন আরাফাতকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখার জন্য বলা হয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষকে। তবে একপর্যায়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যান সংশ্লিষ্টরা। তবে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে কারাগারে দুই মাস কাটান তিনি। অবশ্য এ সময়ে আলেম হিসেবে কেউ কেউ তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারের চেষ্টা করেন। তবে আলেমদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে তাদের জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে নানাভাবে হয়রানির শঙ্কা থাকে বলে জেল-সংশ্লিষ্টরা তাকে জানান। মামলায় নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে বেশ কষ্ট হয়েছে তার। পরে মামলার চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

এর আগে ধর্মের নামে বিকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে রাজধানীর কদমতলী থানায় তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। সেই মামলায় দীর্ঘ প্রায় এক বছর হাজিরা দিতে হয়। একপর্যায়ে সেই মামলা খারিজ হয়ে যায়। এভাবেই হয়রানির শিকার হন তিনি।

বিগত সময়ে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হতো জানিয়ে মাওলানা ইয়াসীন আরাফাত বলেন, কওমি ঘরানার আলেম হওয়া সত্ত্বেও মাহফিলের বক্তব্যে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম নেওয়ার কারণে তাকে জামায়াত-শিবিরের বক্তা আখ্যা দিয়ে দাওয়াত না দিতে প্রচার করা হয়। এভাবে অনেক মাফফিল থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। অনেক সময় মাহফিলে যাওয়ার পথে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় অথবা কয়েক দিন আগে বলা হয় যে আপনার দাওয়াত বাতিল করা হয়েছে। এভাবে অসংখ্য বাধার শিকার হন তিনি।

মাওলনা ইয়াসীন আরাফাত বলেন, ২০১৫ সালের দিকে একটি মাহফিলের অনুমতির জন্য থানায় গিয়েছিল কমিটি। ওসি অতিথিদের নাম জানতে চাইলেন। নামের তালিকা ইয়াসীন আরাফাতের নাম দেখেই সেটি ফেলে দিলেন তিনি। ওসি বললেন, ইয়াসীন আরাফাত নামে শিবিরের একজন নেতা আছে। নামের মিল থাকলে বা কিছু নামের প্রতি তারা কঠোর অবস্থান ছিল। এভাবে বিরোধী মত দমনে চরিত্রহনন করতে যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই তারা করেছে।

ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকরা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাহফিলের মঞ্চে উঠে বলা হতো-এখানে রাজনৈতিক কোনো কথা বলা যাবে না। অথচ মাহফিলে তাদের দলের লোকরাই সেখানে গিয়ে রাজনীতির কথা বলেন। আলেমরা তো কোরআন-হাদিস ও ন্যায়সংগত কথা বলেন। এ জন্য এসব কথা তাদের সহ্য হয় না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তাদের চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এভাবে বাধা দিতেন। তাদের অত্যাচারে একসময় সমাজে ভালো মানুষ থাকতে পারতেন না। তারা ওয়াজ মাহফিলে সরকারবিরোধী কথা না বলতেও নির্দেশনা দিতের।

আওয়ামী আমলে আলেম-ওলামা ও দাড়ি-টুপিধারীদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করায় তাদের সব সময় আতঙ্কে চলতে হতো। হেফাজতের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তিনি এই অভিজ্ঞতার শিকার হন। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি চলাকালে শাহবাগ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ‘রাজাকার’ যাচ্ছে বলে আওয়াজ করা হয়। বিগত সরকার আলেম-ওলামাদের পোশাকটাকেই রাজাকারের পোশাক বানিয়ে দিয়েছিল। এ ধরনের আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে অনেকে দাড়ি কেটে ফেলত।

অনেক মা-বোন তাদের সন্তানদের ওয়াজ মাহফিলসহ ধর্মীয় কাজে যেতেও সতর্ক করতেন। কারণ কোন সময় কাকে ধরে জঙ্গি বানিয়ে দেয়, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। মূলত, আলেম-ওলামাদের ওপর এত বেশি নির্যাতন হয়েছে, যার কারণে সেই আওয়ামী সরকারের খুব নিকৃষ্টভাবে পতন হয়েছে। তাই আগামীতে কেউ যেন ইসলাম ও আলেমদের প্রতিপক্ষ না বানায়, সেই আহ্বান জানান তিনি।