Image description

‘ছুয়াডা ফুটবল খেলায় দেখি কত লোকের কত কথা শুনিচি। লইজ্জা শরম নাই, বেটি ছুয়া হয় হেনে খেলাবা যাছে, বেটি ছুয়াডার বিহা হবেনি। হামরা কাহারো দশকথাত কান দিইনি। লোকের কথাত কান দিলে হামার লাভ হবেনি। নিজের বিবেক থেকে হামার ছুয়াডা সবকিছু করে আগায় গেইছে।’

দৃঢ়তার সঙ্গে কিছুটা উঁচু স্বরে কথাগুলো বলছিলেন সাফজয়ী অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় স্বপ্না রানীর মা ছবিলা রানী। স্বপ্নার ফুটবল খেলা নিয়ে যাঁরা নানা কটুকথা বলতেন, আজ উল্টো তাঁরাই স্বপ্নার প্রশংসা করেন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন আড্ডায় স্বপ্নার স্বপ্নজয়ের গল্প বলছেন। টেলিভিশনে চোখ লাগিয়ে দেখছেন স্বপ্নার ফুটবল–নৈপুণ্য।

স্বপ্না রানীর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে। বাবা নীরেন চন্দ্র (৬২) কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি মুড়ির ব্যবসা করতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন শুয়ে-বসেই সময় কাটছে তাঁর।

চার ভাইবোনের মধ্যে স্বপ্না রানী ছোট। সাফজয়ী অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় নারী ফুটবল দল ছাড়াও সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়শিপে জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন। অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সদস্যও ছিলেন স্বপ্না।

ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে সরাসরি ফ্রি–কিকে গোল করে স্বপ্না রানী একটু বেশিই আনন্দিত (৭ নম্বর জার্সি)
ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে সরাসরি ফ্রি–কিকে গোল করে স্বপ্না রানী একটু বেশিই আনন্দিত (৭ নম্বর জার্সি)শামসুল হক

রানীশংকৈলের নন্দুয়ার ইউনিয়নের বলিদ্বারা বাজার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শিয়ালডাঙ্গী গ্রামের শেষ মাথায় স্বপ্না রানীর বাড়ি। খানিকটা ভেতরে হলেও বাড়ি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না। ছোটবেলা থেকে পাড়ার মধ্য দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কিলোখানেক দূরে জঙ্গলবিলাশ মাঠে ফুটবল অনুশীলনে যাওয়া ও বিভিন্ন সময় আন্তস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার সুবাদে এলাকায় বেশ পরিচিত স্বপ্না।

গত বুধবার স্বপ্নার গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছাউনি ও খড়-বাঁশের বেড়ার দুই কক্ষের একটি মাটির ঘর। পাশে পাকা ঘরের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ছোট্ট উঠানে চেয়ারে বসা স্বপ্নার বাবা নীরেন চন্দ্র। গরুর খাবার দিতে ব্যস্ত ছবিলা রানী। ঘরের বারান্দায় সেলাইয়ের কাজ করছেন স্বপ্নার বোন।

মেয়ের কথা বলতেই ভীষণ উচ্ছ্বসিত বাবা নীরেন। খেলার প্রতি মেয়ের আগ্রহের কথা, কোথায় কোথায় খেলেছেন, কী কী পুরস্কার জিতেছেন, সব গল্প শোনান। পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনের কটূক্তির কথাও জানালেন। নীরেন বলেন, ‘মেয়েটা আমার কখনো কারও কথায় কোনো উত্তর করেনি। আমাদেরও নিষেধ করত। আমরাও মেয়েকে উৎসাহ দিয়েছি। মেয়ে আজ ওপর লেভেলে খেলছে। এটা অনেক বড় আনন্দের।’

সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা এসেছে নীরেন চন্দ্রের। একসময় বড় মেয়ে দরজির কাজ করে বাবার সংসারে সহযোগিতা করেছেন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলেও পড়ালেখার পাশাপাশি কাপড় সেলাইয়ের কাজ করছেন। সম্প্রতি সংসারের হাল ধরেছেন স্বপ্না। সর্বশেষ গত ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে বাবাকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলে গেছেন।

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সাফ অনূর্ধ্ব–২০ চ্যাম্পিয়নশিপে এমন গোল উদ্‌যাপন ৯ বার করেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। মাঝে ৭ নম্বর জার্সি পরিহিত স্বপ্না রানী
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সাফ অনূর্ধ্ব–২০ চ্যাম্পিয়নশিপে এমন গোল উদ্‌যাপন ৯ বার করেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। মাঝে ৭ নম্বর জার্সি পরিহিত স্বপ্না রানীপ্রথম আলো

শিক্ষাজীবনের শুরুতে বলিদ্বারা শিখন স্কুলে ভর্তি হন স্বপ্না। এরপর বনগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। স্বপ্নার ভাই রূপচাঁদ জানান, ২০১৭ সালের দিকে আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে ভালো করেন স্বপ্না। এরপর স্থানীয় শিক্ষক (নাজিম স্যার) তাঁকে ভর্তি করেন রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল দলে। এরপর ২০১৮ সালে ঢাকার বিকেএসপিতে ভর্তি সুযোগ পান। তার পর থেকে নারী লীগ, অনূর্ধ্ব-১৪, সাফ অনূর্ধ্ব-২০ খেলেছেন স্বপ্না। তাঁকে নিয়ে এলাকাবাসী অনেক গর্ব করেন। ভাই হিসেবে অনেক ভালো লাগে তাঁর।

মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মা ছবিলা রানী। স্বপ্নার শিক্ষক নাজিম ও তাজুল স্যারের প্রশংসা করেন। ঘরে ঢুকে ট্রাংক খুলে বের করলেন বিভিন্ন সময়ে মেয়ের পাওয়া ট্রফি, সনদ ও ছবি। কাপড়ে মুড়িয়ে ট্রাংকের ভেতরে যত্ন করে রেখেছেন মেয়ের সাফল্যস্মারক। নতুন ঘর বানানো শেষ হলে একটি আলমারি কিনবেন। সেখানে সাজিয়ে রাখা হবে স্বপ্নার অর্জন।

স্থানীয় শিশু-কিশোরদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন স্বপ্না। বনগাঁও স্কুলের শিক্ষক নুরুন্নবী বলেন, একসময় ছিল, মেয়েদের খেলাধুলা নিয়ে বাধা আসত। সময় বদলেছে। এখন তাঁরা মেয়েদের নিয়ে গর্ববোধ করেন। বিকেল হলেই মেয়েরা খেলার মাঠে অনুশীলনে যায়। কিছুদিন আগে ফুটবল একাডেমির মেয়েরা তাঁদের স্কুলে ১৯ দিনের একটা ক্যাম্প করেছে। তিনি বলেন, খেলাধুলার কারণে ছেলেমেয়েরা মুঠোফোন থেকে দূরে থাকবে। তা ছাড়া শরীরচর্চা, ব্যায়াম ও নির্মল আনন্দের অংশ হচ্ছে খেলাধুলা। এখন ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি অভিভাবকেরাও খেলাধুলায় বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।