Image description

খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তর পর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…

আজকের তারকা: রানী হামিদ

 

৮২ বছর বয়সেও চুটিয়ে দেশ-বিদেশে দাবা খেলে যাচ্ছেন। রানী হামিদ শুধু বাংলাদেশের দাবার রানি নন, এক সাহসী নারীর প্রতীক, লাখো নারীর অনুপ্রেরণা, দাবার বিশ্বে বাংলাদেশের দূত। এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর জীবনের নানা গল্প, যেখানে আছে তাঁর নাম নিয়ে বিড়ম্বনা, বিয়ে, সেলাইয়ের গল্পসহ অনেক কিছু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম
প্রথম আলো

গত মাসে দিল্লিতে টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে একা হয়ে গিয়েছিলেন, কারণ আপনার সঙ্গী দাবাড়ুকে ভারতে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতিটা কেমন ছিল?

রানী হামিদ: দিল্লির আয়োজকেরা খুব সম্মান দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সব খরচও তারাই বহন করেছিল, আন্তরিক আপ্যায়নও করেছে। যেখানে রেখেছে, খেলাও হয়েছে সেখানেই। ফলে খুব একটা সমস্যা হয়নি। তবে আমার সঙ্গী দাবাড়ুকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়াটা আমাকে গভীরভাবে কষ্ট দিয়েছে। অনেক অনুরোধ করেও কাজ হয়নি। দিল্লির সেই বাজে অভিজ্ঞতার পর আর মুম্বাইয়ে যাইনি। সেখানেও খেলার আমন্ত্রণ ছিল।

প্রথম আলো

৮২ বছর বয়সেও আপনি এখন ঢাকায় দাবা ফেডারেশনে চলমান জিএম জিয়া স্মৃতি দাবায় খেলছেন। এই প্রেরণা আসে কোথা থেকে?

রানী: তোমরা খালি বয়স বয়স করো! আগে তো বুড়োরা দাবা খেলত, হুক্কা টানত আর দাবার বোর্ডে বসে থাকত ( হাসি)। এখন দাবা আমার টাইম পাস, আমার আনন্দ। আমি এখনো খেলি মনের শান্তির জন্য।

প্রথম আলো

সারা জীবন দাবার ঘুঁটি এত নাড়াচাড়া করেছেন, আবার জন্মালে আপনি দাবার বোর্ডে কী হতেন, রানি, রাজা, না ঘোড়া-হাতি?

রানী: (হাসি) দাবার বোর্ডে ঘোড়া লাফিয়ে চলে, হাতি খোলা জায়গায় দুরন্ত। রানির ক্ষমতা সবার চেয়ে বেশি। পণের আরেক কাজ, রাজার অবস্থান ভিন্ন। ফলে নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না, ঠিক কী হতাম।

দাবার বোর্ডে মগ্ন রানী হামিদ
দাবার বোর্ডে মগ্ন রানী হামিদপ্রথম আলো
প্রথম আলো

এখন তো সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্লিটজ, র‍্যাপিড দাবা ইত্যাদি এসেছে। স্ট্যান্ডার্ড দাবায় কখনো খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছেন?

রানী: এখন প্রায়ই ঘুম পায়। প্রতিপক্ষ চাল না দিলে বিরক্ত লাগে। এই বয়সে আর ধৈর্য থাকে না। তবে বোর্ডে ঘুমিয়ে পড়ি না (হাসি)। হয়তো একটু ঝিমাই।

প্রথম আলো

দাবার বাইরের জীবনটা কেমন আপনার?

রানী: দাবা আমার দ্বিতীয় জীবন। প্রথম জীবন সংসার। গৃহিণী হিসেবে ঘর সামলানো, বিভিন্ন বিল দেওয়া-সবই করেছি।

প্রথম আলো

সবচেয়ে ভালো লাগে কী?

রানী: ঘুম (হাসি)। আর একসময় নাটক-সিনেমা দেখা হতো। হিন্দি সিরিয়াল দেখতাম। বিটিভিতে ‘এই সপ্তাহের নাটকের’জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম। এখন এত নাটক, কোনটা রেখে কোনটা দেখব! আগে ঘোরাঘুরি ভালো লাগত। বই পড়ার অভ্যাসও আছে। বিভূতিভূষণ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-সবার বই পড়েছি। বই পেলেই হলো। আগে যখন লাইব্রেরি থেকে বই আনাতাম, তারকা চিহ্ন দিয়ে রাখতাম বইয়ে। কারণ, একই বই নিয়ে আসত বারবার।

প্রথম আলো

নাটক-সিনেমার কথা বললেন। কারও অভিনয় ভালো লাগত?

রানী: হেমা মালিনীর সিনেমা ভিসিআরে দেখেছি। তখন সিনেমা দেখাটা উৎসবের মতো ছিল। এখন অনেক সিনেমা, নাটক। কিন্তু মজা পাই না। দুর্লভ জিনিসেই আকর্ষণটা বেশি থাকে।

পরিবারের সঙ্গে রানী হামিদ
পরিবারের সঙ্গে রানী হামিদরানী হামিদের অ্যালবাম
প্রথম আলো

সেলাই নাকি ভালো পারতেন আাপনি?

রানী: হ্যাঁ। সন্তানেরা ছোট থাকতে একটা কাপড়ও দর্জির কাছে দিতাম না। ওদের প্যান্ট-শার্ট, শীতের কাপড় সব নিজেই বানাতাম। সেলাই শিখেছি আব্বার (পুলিশ কর্মকর্তা মমতাজ আলী) কাছ থেকে। তিনি সিলেট এমসি কলেজে পড়তেন, পাশেই একটা দর্জির দোকান ছিল। সেখান থেকে শিখেছিলেন। তিনি খেলাধুলায়ও ভালো ছিলেন। টেনিস, ক্যারম, দাবা...সবকিছুতেই।

প্রথম আলো

রান্নাবান্না করার সময় পান?

রানী: রান্নার লোক থাকে, তারাই করে। আমি বা মা কেউই রান্নায় ঝোঁক দিইনি। খেলাধুলায়ই আগ্রহ ছিল বেশি। তবে আমার রান্নার জ্ঞান ভালোই আছে। পাকিস্তানে থাকাকালে বাবুর্চি অসুস্থ হলে রান্না করতে হতো। এক ড্রাইভার ছিল, সে বলত, ‘ম্যাডাম, আপনি সরেন, আমি রান্না করি।’

প্রথম আলো

প্রিয় খাবার কী?

রানী: মিষ্টি খুব ভালোবাসি। আম-কাঁঠালও পছন্দের। পারলে পুরো কাঁঠাল খেয়ে ফেলি (হাসি)। তবে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসক বারণ করেছেন। আগে শুকনা মাছ খেতে পারতাম না, এখন খাওয়া শিখে গেছি ( হাসি)।

প্রথম আলো

আপনার বিয়ে হয়েছিল কবে?

রানী: ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে। তখন আইয়ুব খানের মার্শাল ল ছিল। তিনি (রানী হামিদের স্বামী প্রয়াত লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ) তখন সিলেটে পোস্টেড, আর্মির ক্যাপ্টেন ছিলেন।

বিখ্যাত ফুটবলার ছেলে কায়সার হামিদের সঙ্গে রানী হামিদ
বিখ্যাত ফুটবলার ছেলে কায়সার হামিদের সঙ্গে রানী হামিদকায়সার হামিদের অ্যালবাম
প্রথম আলো

পাত্রের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয়?

রানী: না, না, তখন আবার পরিচয়-টরিচয় কী! প্রেম-ট্রেমেরও সুযোগ ছিল না (হাসি)। তবে আমার হবু হাজব্যান্ড অনেক চেষ্টা করেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, আমি তো দেখাই করি না। ভাগনিকে একদিন পাঠিয়ে দিলেন আমার স্কুলে। আমি তাকে বকা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছি। আমি জানি যে মেয়েরা (ক্লাসমেট, বন্ধুরা) একটু টের পাইলেই আমাকে আর রাখবে না (হাসি)। তখন সিলেটের গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলে পড়ি। তিনি (লে. কর্নেল হামিদ) বাসায় গিয়ে রিপোর্ট করেছেন, মেয়ে খুব বদমেজাজি।

প্রথম আলো

সেই ‘বদমেজামি খেতাব’ঘোচালেন কীভাবে?

রানী: আমার হবু হাজব্যান্ড তখন খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি তাঁর কাজিন বড় বোনকে আমার বাসায় পাঠালেন। বাসায় এসে ওরা খুশি। মেয়েটা ভালো, হাসিখুশি। সবাই গিয়ে পজিটিভ রিপোর্ট করল, প্রশংসা করল।

প্রথম আলো

হবু স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিয়ের আগে?

রানী: বিয়ের পাঁচ দিন আগে, আকদের পরদিন দেখা। অনেক কৌশলে উনি আমাকে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে গিয়ে দেখা করেন (হাসি)। আমার আব্বা বিয়ের কিছুদিন আগে ছেলের ছবি সামনে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।’বিয়ের সময় মেয়ের অনুমতি বলতে এ-ই।

প্রথম আলো

দাবার জীবনে স্বামীর ভূমিকা কেমন ছিল?

রানী: বিশাল। উনি ছিলেন ক্রীড়াপ্রেমী। আমাকে খেলাধুলায় বরাবর সমর্থন দিয়েছেন। দাবার উন্নয়নে কাজ করেছেন, হয়তো অনেকে জানেও না।

প্রথম আলোর আজীবন সম্মাননা পুরস্কার হাতে রানী হামিদ
প্রথম আলোর আজীবন সম্মাননা পুরস্কার হাতে রানী হামিদপ্রথম আলো
প্রথম আলো

শুনেছি, আপনার লেখা দুটি বইয়ে ওনার অবদান ছিল...

রানী: হ্যাঁ, আমি নামেই লেখক। ৮০ ভাগ কাজ উনিই করেছেন। লেখা, সম্পাদনা, ছাপানো। আমাকে বই লেখায় জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি তো চ্যাম্পিয়ন হয়েই যাচ্ছ, নতুন মেয়ে আসছে না। বই লেখো। তোমার লেখা পড়ে মেয়েরা আগ্রহী হতে পারে।’আমি তখন ৯ বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছি (সব মিলিয়ে ১৯৭৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত জাতীয় মহিলা দাবায় রেকর্ড ২০ বার চ্যাম্পিয়ন)। পরে তাঁর কথায়ই বই লিখি।

প্রথম আলো

দাবার কৌশল না জীবনের কৌশল, কোথায় বেশি ভুল করেছেন?

রানী: (হাসি) দেখলাম, জীবনে যেসব ভুল করি, বোর্ডেও প্রায় একই ধরনের ভুল হয়েছে। ভুল করাটা একরকম অভ্যাস। বোর্ডের ভুলের সঙ্গে জীবনের অনেক মিল আছে। তবে দাবার বোর্ডেই বেশি ভুল করেছি। জীবনের ভুলগুলো হয়তো টুকটাক। একজন বিদেশি গ্র্যান্ডমাস্টার একবার বলেছিল, সে নাকি বারবার একই ভুল করে বোর্ডে। আমারও তা-ই হয়। বারবার একই ভুল।

প্রথম আলো

সেটা কী রকম?

রানী: ধরো, আমার হাতে প্রচুর সময়। বোর্ডে ভালো পজিশন। আমি আরামে খেলতে পারি, কিন্তু তাহাহুড়ো করে একটা ভুল চালে সর্বনাশ। ভুল করাটা অভ্যাসের ব্যাপার। সাবধানীরা এসব ভুল করে না।

প্রথম আলো

আপনি ছোটবেলায় দৌড়েও ভালো ছিলেন। অ্যাথলেট হলেন না কেন?

রানী: ছোটবেলায় মনের আনন্দে খেলতাম। বাড়িতে একটাই নিয়ম ছিল, মাগরিবের আজান হলে ঘরে এসে জায়নামাজে দাঁড়াতে হবে। শৈশব কেটেছে সিলেটে। তবে বাবার পোস্টিংয়ের কারণে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। চার ভাই, চার বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। প্রায় সব খেলায় চ্যাম্পিয়ন হতাম। ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন’পুরস্কারও পেয়েছিলাম। আমার শিক্ষক চেয়েছিলেন, আমাকে পাকিস্তানে নিয়ে পাকিস্তান অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করাবেন। কিন্তু আব্বা রাজি হননি। উনি মেয়েকে একা ছাড়বেন না। একবার পাকিস্তানের দ্রুততম মানবীকেও দৌড়ে হারিয়েছিলাম।

প্রথম আলো

কীভাবে?

রানী: সম্ভবত ১৯৬৩ সালের কথা। চট্টগ্রামে ছিলাম স্বামীর সঙ্গে। সেখানে এক মেজরের স্ত্রী আমার কাছে এল। সে নিজে পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট ছিল। বলল, ‘তোমার কথা শুনেছি, তুমি নাকি দৌড়ে খুব ভালো? পাকিস্তানে গেলে চ্যাম্পিয়ন হতে, এমনটাও নাকি বলেছ! চলো, আমরা দৌড়াই।’আমি বললাম, এখন কী দৌড়াব, বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে! কিন্তু সে ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত খোলা রাস্তায় দৌড় প্রতিযোগিতা হলো। আমি শাড়ি পরে, সে পায়জামা। দুবার দৌড়ে আমিই ফার্স্ট!

সতীর্থ দাবাডুদের সঙ্গে রানী হামিদ
সতীর্থ দাবাডুদের সঙ্গে রানী হামিদদাবা ফেডারেশন
প্রথম আলো

দৌড় ছাড়া নাচ-গানে ঝোঁক ছিল?

রানী: ওমা, এগুলো আবার না থাকে নাকি! বাবা গানের মাস্টার রেখেছিলেন ছোটবেলায়। কিন্তু মাস্টার এলেই আমি পালিয়ে মাঠে চলে যেতাম। মাস্টার পেছনে পেছনে মাঠে গিয়ে ধরে আনতেন (হাসি)! শেষে মাস্টার একদিন বাবাকে বললেন, ‘আপনার মেয়ে গান শিখবে না। আমাকে ছেড়ে দিন।’বাবা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। মাকেও শেখাতেন। ‘কে বিদেশি বন উদাসী…’গানটা হারমোনিয়ামে গাইতে পারতাম।

প্রথম আলো

এখন গুনগুন করে কোন গানটা গান?

রানী: এখন আর গাই না। তবে একটা গান খুব ভালো লাগত বা এখনো লাগে, এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু... ।

প্রথম আলো

এত দেশে খেলেছেন, কোথায় বেশি ভালো লেগেছে?

রানী: নরওয়েতে একবার গিয়ে দেখি, ২৪ ঘণ্টাই দিন! সেটি ছিল অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। তবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি লন্ডনে। সেখানে আমার দুই ভাই থাকে। ওদের সঙ্গে সময় কাটত দারুণ।

প্রথম আলো

কোনো দেশে গিয়ে মনে হয়েছে, এটা আমার দ্বিতীয় বাড়ি?

রানী: কখনো না। নিজের দেশটাই সবচেয়ে ভালো লাগে। পাকিস্তানে দুই বছর টানা থেকেছিলাম। কিন্তু দেশের টানটা সব সময়ই অনুভব করেছি। বাংলাদেশের মাটিতে প্লেন নামার মুহূর্তটা এক অনন্য সুখের ছিল। ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা।

প্রথম আলো

আপনি একমাত্র খেলোয়াড় যিনি শাড়ি পরে খেলতে যান বিদেশে। আয়োজকেরা যদি কখনো বলত যে শাড়ি পরে খেলা যাবে না, খেলা ছেড়ে দিতেন?

রানী: ছাড়তাম না। পায়জামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ-এগুলো তো পরা যায়। শালীনতা রেখে পর্দা করে যে পোশাক পরে খেলা যেত, ওটাই পরতাম।

প্রথম আলো

শাড়ি পড়ে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন?

রানী: দারুণ। অনেকে দৌড়ে আসে আমার কাছে। এসে বলে, ‘তোমার সঙ্গে আমি খেলেছি।’আমি বলি, কবে? বলে, ১২ বছর আগে। আমি বলি, আল্লাহ বলে কী! আমি তো ১২ দিন আগের কথাই মনে রাখতে পারি না। অবাক লাগে। যেভাবে মানুষ মনে রাখছে, এটা অন্য রকম অনুভূতি। বিদেশে বাংলাদেশের শাড়ির বিজ্ঞাপন হয়ে গেছি (হাসি)।

দাবা নিয়ে বইও লিখেছেন রানী হামিদ
দাবা নিয়ে বইও লিখেছেন রানী হামিদ
প্রথম আলো

ফেলে আসা দিনের এখনো কী বেশি মিস করেন?

রানী: গ্রাম। পুকুরে গোসল করতে খুব ভালো লাগে। বাড়িতে গেলে সব সময় এটা করি। সাঁতার কাটি। আগে মুরগির বাচ্চা পালতাম। গৃহিণী হিসেবে বাগান করা, সবজি চাষ...এগুলো করতাম। স্বাধীনতার পর একটা চৌবাচ্চায় তেলাপিয়া মাছ চাষ করতাম। অনেক মাছ হতো। গরু পালতাম। খাঁটি দুধ খেতাম।

প্রথম আলো

আপনার আসল নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা। রানী ডাকনাম। আসল নামটা কীভাবে হারিয়েই গেল!

রানী: আব্বা রানি এলিজাবেথের অধীনে চাকরি করতেন। তাই হয়তো মেয়ের ডাকনাম রাখলেন রানী। এটা ধারণা থেকে বলছি। কারণ, এ নিয়ে কখনো বাবার সঙ্গে কথা হয়নি। খুব লজ্জিত ছিলাম আমার এই নামের জন্য। কারণ, অনেক সময় পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা আমাকে খোঁচা দিত, ‘এই রানী, তোর রাজা কই!’কী যে রাগ লাগত, বলার মতো না (হাসি)। লজ্জিত ছিলাম বাবার দেওয়া নামটা নিয়ে (হাসি)। তবে নামটা যে এভাবে ছড়িয়ে যাবে, কে জানত! সবাই আমাকে ‘দাবার রানি’উপাধি দিয়েছে।

প্রথম আলো

জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে?

রানী: আমি খেলায় আসি চার সন্তানের মা হওয়ার পর। সে সময় দাবা ছাড়া আর কিছু খেলা যায় না, ক্যারাম ছাড়া। আমি ভেবেছিলাম সময় কাটানোর জন্য চাকরি করব। স্কুলশিক্ষক হবে। কিন্তু তা আর হওয়া হয়নি। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার হই। এরপর এগোতে পারিনি, যতটা পারার কথা ছিল। দোষ আমার। আবার ফেডারেশন, দেশেরও দায় আছে।

প্রথম আলো

তারপরও অনেক প্রাপ্তি আছে। কোনটাকে আগে রাখেন?

রানী: আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পাওয়া। ব্রিটিশ দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ব্রিটিশরা আমাদের একসময় শাসন করত। সাংবাদিকদের সংস্থার দেওয়া পুরস্কারও বড় প্রাপ্তি। প্রথম আলোর আজীবন সম্মাননা পেয়েছি।

প্রথম আলো

খেলার বাইরে তৃপ্তির জায়গা কোথায়?

রানী: ডিওএইচএ// একটি স্কুল শুরু করেছিলাম কয়েকজন সিনিয়র অফিসারের স্ত্রী মিলে। আমার স্বামী তখন চাকরিতে ছিলেন। সত্তরের দশকে শুরু হয়। স্কুলটা এখনো আছে।

দাবা খেলতে গিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন রানী হামিদ
দাবা খেলতে গিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন রানী হামিদদাবা ফেডারেশন
প্রথম আলো

সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতি?

রানী: ২০০৮ সালে স্বামীর মৃত্যু। চিকিৎসক বারণ করতেন, তবু মিষ্টি খেতেন খুব। ছোট ছেলে ববি হামিদও মারা গেছে। সে ক্রীড়াপাগল ছিল। আমাকে দাবায় সাহায্য করত।

প্রথম আলো

আপনি ক্লাস টুতে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গিয়েছিলেন শুনেছি।

রানী: ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে সরাসরি ক্লাস টুতে ভর্তি হই। তখন ভাষা আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলাম সিনিয়রদের সঙ্গে। সিনিয়ররা ক্লাসে এসে বললেন, ‘সবাই বের হও।’তখন বুঝতাম না কিছু, কিন্তু স্লোগান দিয়েছি, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’! এটা আমার জীবনের গর্বের অংশ।

প্রথম আলো

আপনি ফুটবলার কায়সার হামিদের মা। ছেলের খেলা দেখতেন?

রানী: খুব। সম্ভবত মাঠে একমাত্র মহিলা দর্শক ছিলাম।

প্রথম আলো

দাবার বাইরে প্রিয় খেলা?

রানী: দেখতে ভালো লাগে ফুটবল। তবে খেলতে ভালোবাসি ক্যারাম। ভালো খেলি। ব্যাডমিন্টনে বুড়ো বয়সেও মিক্সড ডাবলসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি আমি আর আমার স্বামী। বাস্কেটবলও পছন্দ করতাম।

প্রথম আলো

প্রিয় খেলোয়াড় কে?

রানী: আমার একটা সমস্যা, দুর্বল দলকে সাপোর্ট দিই। সবাইকেই ভালো লাগে। আমাদের মেয়ে ঋতুপর্ণা যখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গোল করল, মনে হলো মেসি গোল করেছে! আমি সব সময় বলি, ‘শট করবা পোস্টে, গোলকিপারকে ধরতে দাও... বাইরে মেরে লাভ কী!’

প্রয়াত স্বামী লে. কর্নেল হামিদের সঙ্গে রানী হামিদ
প্রয়াত স্বামী লে. কর্নেল হামিদের সঙ্গে রানী হামিদরানী হামিদ
প্রথম আলো

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল প্রথমবার এশিয়ান কাপে খেলবে, ভেবে কেমন লাগছে?

রানী: মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে যে চেষ্টা করলেই সম্ভব। দাবায় ভারতের দিকে তাকান, ওদের ছেলেমেয়েরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। অথচ আমরা একসঙ্গে শুরু করেছিলাম।

প্রথম আলো

এখনো কি গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন?

রানী: এখন তো শিশুদের সঙ্গেও পারি না (হাসি)। যাদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম, তারা অনেকে মারা গেছে, অনেকে বিদেশে। ফলে এখন আর স্বপ্ন-টপ্ন নেই।

প্রথম আলো

টিটি তারকা জোবেরা রহমান লিনু আত্মজীবনী লিখেছেন। আপনি লিখবেন?

রানী: লিখে লাভ কী! পৃথিবীটা ক্ষণস্থায়ী। চলে গেলে কে কাকে মনে রাখে! এই সাক্ষাৎকার, পেপার কাটিং সব কোথায় যে হারিয়ে যাবে!