Image description

জীবদ্দশায় তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, ...এই দেশ, এই দেশের মাটি, এই দেশের মানুষই আমার সবকিছু।’ দেশ-মাটি ও মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা নিবিড় বন্ধন ছিন্ন করে চিরবিদায় নিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থতায় ভোগা এই আপসহীন নেত্রী গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

২৩ নভেম্বর শেষ দফায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই কার্যত খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। এক মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকেরা তাঁর চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গতকাল সকালে চিরবিদায় নেন খালেদা জিয়া। এ সময় বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তাঁর স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, খালেদা জিয়ার ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্যরা শয্যাপাশে ছিলেন।

নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ হাতে খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে তোলা
নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ হাতে খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে তোলা

দলীয় প্রধানের মৃত্যুর খবর ‘মহাকালের সমাপ্তি’ শিরোনামে বিএনপি প্রকাশ করে দলের মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে। সাড়ে ছয়টার দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মুঠোফোনে দলের শীর্ষ নেতাদের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ‘আম্মা আর নেই।’

খালেদা জিয়ার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটল গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা দ্যুতি ছড়ানো গৌরবময় একটি অধ্যায়ের। তাঁর মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সরকার তাঁর মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং বিএনপি সাত দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আজ বুধবার বেলা দুইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে তাঁকে শেরেবাংলা নগরে (জিয়া উদ্যান) স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে।

স্বজনদের কান্নার রোল

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে শোকবই খোলা হয়েছে
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে শোকবই খোলা হয়েছেছবি: বিএনপির ফেসবুক পেজ

২৫ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর প্রতিদিনই হাসপাতালে মাকে দেখে বাসায় ফিরতেন তারেক রহমান। গত সোমবার বিকেলে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে রাত ১০টার পর এভারকেয়ার হাসপাতালে মাকে দেখতে যান। রাত দুইটায় তারেক রহমান হাসপাতাল থেকে বের হন, তিনটার দিকে গুলশানের বাসায় ফেরেন। তারেক রহমান হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর রাত দুইটার পরপর সংবাদ ব্রিফিং করেন খালেদা জিয়ার চিকিৎসক দলের সদস্য ও বিএনপির নেতা এ জেড এম জাহিদ। তিনি জানান, বিএনপির চেয়ারপারসন অত্যন্ত একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছেন।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রাত চারটার দিকে তারেক রহমানকে খবর দেওয়া হয় যে খালেদা জিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। তখন মাত্র তিনি বিশ্রামে গেছেন। খবর পেয়ে তারেক রহমান স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে দ্রুত আবার হাসপাতালে ছুটে যান। একে একে পরিবারের অন্য সদস্যরাও হাসপাতালে পৌঁছান। চিকিৎসকেরাসহ পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়াকে রাখা আইসিইউতেই ছিলেন। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর সদস্যসচিব আতিকুর রহমান। তিনি পরিস্থিতির বর্ণনা করে প্রথম আলোকে বলেন, তখন কান্নার রোল পড়ে যায় হাসপাতালের আইসিইউতে। পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন, কান্নায় ভেঙে পড়েন তারেক রহমান।

সকাল আটটায় হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলন করে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার খালেদা জিয়ার মৃত্যুর কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক মহল শোক প্রকাশ করেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে নেমে এসেছে গভীর শোক।

শেষ দিনগুলোতে ছিলেন সংজ্ঞাহীন

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়া
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়াফাইল ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির নেতা ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে খালেদা জিয়া প্রায় সংজ্ঞাহীন ছিলেন। মাঝেমধ্যে তাকাতেন, ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করতেন। শেষ দফায় খালেদা জিয়া ৩৭ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ভর্তির পর প্রথমে তাঁকে কেবিনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সিসিইউতে, আরও অবনতি হলে শেষে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সিসিইউতে থাকার সময় একদিন শয্যাপাশে থাকা ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমানের সঙ্গে সামান্য কথা বলেন। এরপর ১৯ ডিসেম্বর জুবাইদা রহমান বাংলাদেশ থেকে লন্ডন যাওয়ার সময় বিদায় নিতে গেলে সামান্য মাথা নেড়ে বিদায় দেন।

গৃহকোণ থেকে রাজনীতিতে

খালেদা জিয়া (জন্ম ১৯৪৫–মৃত্যু ২০২৫)
খালেদা জিয়া (জন্ম ১৯৪৫–মৃত্যু ২০২৫)

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটি ছিল আকস্মিক, কিন্তু পথচলা ছিল দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপি পড়ে যায় গভীর সংকটে। নেতৃত্বশূন্য দল, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন খালেদা জিয়া। তখন তিনি ছিলেন একজন গৃহবধূ। রাজনীতিতে নামার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু সময়, পরিস্থিতি ও নেতৃত্বের শূন্যতার মাঝে তিনি দলের হাল ধরেন এবং দ্রুত সামনে চলে আসেন। বিএনপির সদস্য হয়ে প্রথমে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং শেষ পর্যন্ত দলের চেয়ারপারসন হন তিনি। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের কম সময়ের মধ্যেই হন প্রধানমন্ত্রী। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দলীয় প্রধানের পদে ছিলেন।

বিএনপির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া মানে স্বৈরাচারকে ‘না’; গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ‘হ্যাঁ’। আমৃত্যু এটি ছিল তাঁর আপসহীন সংগ্রামের মূলমন্ত্র। ক্ষমতায় থাকতে শিক্ষার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রা, অ্যাসিড–সন্ত্রাস রোধ, সবুজ বেষ্টনী গড়া, শিল্পের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সংস্কার, যোগাযোগে বিপ্লব ছিল উল্লেখযোগ্য।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্থান

’৯০-এর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাস গড়েন খালেদা জিয়া। তিনি হন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তাঁর হাত ধরেই রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটে, যা দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার একটি বড় মাইলফলক। তাঁর হাত ধরেই দেশে রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনই খালেদা জিয়াকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় নেত্রীতে পরিণত করে। ১৯৮৩ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৭-দলীয় ঐক্যজোট। টানা ৯ বছরের আন্দোলনে তিনি হয়ে ওঠেন ‘আপসহীন নেত্রী’।

খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হন—১৯৯১, ১৯৯৬ (স্বল্পকাল) ও ২০০১ সালে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যেমন তিনি বহু দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে সমঝোতার পথেও হেঁটেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রশ্নে প্রথমে দ্বিমত থাকলেও জনদাবির মুখে তিনি তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তিনি ছিলেন পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো নেতা, যিনি প্রয়োজন হলে নিজের অবস্থান থেকেও সরে আসতে পারেন।

বাংলাদেশে জোটভিত্তিক রাজনীতির বিস্তারে খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ৭-দলীয় জোটের পর ১৯৯৯ সালে গঠন করেন ৪-দলীয় জোট, যা ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮-দলীয় ও ২০-দলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন তিনি। দেশের স্বার্থে সমমনা কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা করা তাঁর রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক।

আপসহীন সংগ্রামের পাশাপাশি সংলাপ ও সমঝোতার পথও কখনো পুরোপুরি বন্ধ করেননি খালেদা জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন, জোটভিত্তিক রাজনীতির বিস্তার এবং জাতীয় সংকটে আলোচনার উদ্যোগ—সবই তাঁর বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সাক্ষ্য বহন করে।

এক-এগারো ও কঠিন সময়

২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকার আদালতে খালেদা জিয়া
২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকার আদালতে খালেদা জিয়াফাইল ছবি: প্রথম আলো

২০০৭ সালের এক-এগারোর পর খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ ঝড়। জরুরি অবস্থায় গ্রেপ্তার হন তিনি, গ্রেপ্তার হন তাঁর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। তাঁকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি জানিয়ে দেন, দেশ ছাড়বেন না। তখন বলেছিলেন, ‘এই দেশ, এই দেশের মানুষই আমার ঠিকানা।’ পরবর্তী সময়ে ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ, গুলশানের বাসভবনে অবরুদ্ধ জীবন, কার্যালয়ের সামনে ব্যারিকেড—সবই ছিল তাঁর জীবনের কঠিন অধ্যায়।

এই রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মধ্যেই ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যু হয়। তখন তিনি নিজেই অবরুদ্ধ। সে সময় এক আবেগঘন বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, স্বামী হারিয়েছেন, মা হারিয়েছেন, সন্তান হারিয়েছেন, তবু দেশবাসীই তাঁর স্বজন। এই বক্তব্যই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে মানবিক দলিল হয়ে আছে।

রাজনীতিতে চার দশক ধরে উচ্চারিত একটি নাম

পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে অবস্থিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত প্রাঙ্গণে খালেদা জিয়া। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭
পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে অবস্থিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত প্রাঙ্গণে খালেদা জিয়া। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ফাইল ছবি

দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতির প্রতিটি বাঁকে খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারিত হয়েছে। চার দশকের বিএনপির চেয়ারপারসন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী, শেষজীবনে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক—এসব পরিচয়ে খ্যাত এই নেত্রীর জীবনের ইতি ঘটে গতকাল। রাজনীতিকদের জীবনে উত্থান-পতন থাকে, থাকে মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার-কারাবাস, নির্যাতন, প্রতিপক্ষের আক্রমণ। এ সবই ছিল খালেদা জিয়ার ৪৩ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে। তিনি এমন সব জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন। বিশেষ করে এক-এগারোর সময় গ্রেপ্তার, পরিবারে বিপর্যয়, গৃহহারা হওয়া, অবরুদ্ধ জীবন—সবই সহ্য করেছেন তিনি। উপরন্তু সহ্য করেছেন স্বামী ও সন্তান হারানোর গভীর শোক, সঙ্গে দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা।

দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে দেশে ফেরেন। কিন্তু বয়স, দীর্ঘ কারাবাসের শারীরিক-মানসিক ধকল এবং শারীরিক জটিলতা মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসাও তাঁকে ফেরাতে পারেনি।

মায়ের মৃত্যুর পর দেওয়া এক শোকবার্তায় তারেক রহমান বলেন, ‘আমার মা—বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া—সর্বশক্তিমান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকের কাছে তিনি ছিলেন দেশনেত্রী, গণতন্ত্রের মা। আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন মমতাময়ী মা, যিনি নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশ ও মানুষের জন্য।’

তারেক রহমান স্মরণ করিয়ে দেন, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করা এই নারী বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তবু তিনি ভেঙে পড়েননি। দেশ ও দেশের মানুষই ছিল তাঁর পরিবার।

দীর্ঘ কারাবাস ও অসুস্থতার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। গত ৭ আগস্ট নয়াপল্টনের এক সমাবেশে দেওয়া তাঁর সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তা নতুন প্রজন্মকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়; ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।’

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন। তাঁর বিদায়ও হয়ে উঠেছে গৌরবময়। দলমত-নির্বিশেষে সব মহল থেকে তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করে। তাঁর মৃত্যুর পর তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। শোক জানিয়েছেন সব দল এবং নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ওঠে শোকময়। সম্প্রতিকালে এত সম্মান ও শ্রদ্ধা নিয়ে কোনো রাজনীতিক বিদায় নেননি।

একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

খালেদা জিয়া (১৯৪৫–২০২৫)
খালেদা জিয়া (১৯৪৫–২০২৫)তারেক রহমানের ফেসবুক পেজ থেকে

খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বর্ণিল অধ্যায়। তিনি রেখে গেছেন এক অবিস্মরণীয় জনস্মৃতি। তিনি আর নেই। কিন্তু থেকে যাবে তাঁর সংগ্রাম, তাঁর সিদ্ধান্ত, তাঁর বিতর্ক, তাঁর সাহস এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে খচিত একটি নাম: বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশ আজ শোকাহত।

বিএনপির চেয়ারপারসনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দলের গুলশান ও নয়াপল্টনের কার্যালয় এবং তাঁর বাসভবনের সামনে ভিড় করেছেন অনুসারীরা। তাঁদের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। খালেদা জিয়ার প্রয়াণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করল। তাঁর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটল দেশের রাজনীতির এক আলোচিত অধ্যায়ের।