তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর পর এমন এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশে পা রাখলেন, যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ২০০৮ সালে এক অনিশ্চিত যাত্রায় দেশ ছেড়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আর গতকাল বৃহস্পতিবার ফিরলেন ‘আগামী দিনের সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে। তার এই ফেরা শুধু একজন নেতার ঘরে ফেরা নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক বড় ধরনের অগ্নিপরীক্ষা।
তারেক রহমানের সরাসরি নেতৃত্বে দেশের রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং তিনি গুণগত সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কতটা দৃশ্যমান হবে—এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে জনআকাঙ্ক্ষার দেশ গঠনে তারেক রহমান অপরিহার্য। গতকাল দেশে ফিরে গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, বহু বছর পর নির্বাসন শেষে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট। বিশেষ করে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তার এই শারীরিক উপস্থিতি রাজনৈতিক সমীকরণে আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গতকাল বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন তারেক রহমান। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বুলেটপ্রুফ বাসে উঠে গাড়িবহর সহকারে রওনা হন পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কের দিকে, যেখানে তারেক রহমানকে সংবর্ধনা দিতে সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার কথা ব্যক্ত করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বিকেল ৩টা ৫৭ থেকে কোনো ধরনের ক্রিপ্ট ছাড়াই ১৬ মিনিট বক্তৃতা করেন তারেক রহমান। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ চারটি দিক। সেগুলো হচ্ছে, ভাগ্য বদলের রূপরেখা, উসকানি পরিহার ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ধৈর্য, একাত্তর ও চব্বিশের চেতনাকে ধারণ এবং ন্যায়পরায়ণতা, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়া।
তারেক রহমানের বক্তব্যকে অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ কালবেলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন নির্বাসনে থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করলেন। এ কথা তো স্বীকার করতে হবে যে, মহান আল্লাহর খাস রহমতেই তিনি দেশে ফিরতে পেরেছেন। সুতরাং তারেক রহমান দেশে ফিরে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা আদায় করেছেন। একই সঙ্গে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) প্রদর্শিত ন্যায়পরায়ণতার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। এজন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া চেয়ে বলেছেন, হে সর্বশক্তিমান, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, আপনি আমাদের সাহায্য করুন। আপনি রহমত করলে আমরা জনগণের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবো। আমরা পরিশ্রম ও ঐক্যের মাধ্যমে শহীদদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ। অতএব তারেক রহমানের এই বক্তব্য বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ ও জনআকাঙ্ক্ষার নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী।’
তারেক রহমানের ফিরে আসা বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের জন্য একটি ‘মোরাল বুস্টার’ বা নৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। গত দেড় দশকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করলেও সরাসরি উপস্থিতির অভাব সবসময় অনুভূত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের সশরীরে উপস্থিত হওয়া মানে হলো সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়ন এবং দলের ভেতরের কোন্দল ও গ্রুপিং সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের ভাষায়, দেশে যে ‘রাজনৈতিক শূন্যতা’ ছিল, তারেক রহমানের আগমনে তা পূরণ হবে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণ আরও সহজ হবে।
তারেক রহমান সাম্প্রতিক সময়ে বারবার ‘রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন’-এর কথা বলছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল নয়, বরং রাষ্ট্র এবং রাজনীতির আমূল সংস্কার।’ তার এই বক্তব্যের প্রতিফলন হিসেবে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রমে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান তথা তিনি তার বক্তব্যে সন্ত্রাস, সংঘর্ষ এবং প্রতিশোধের বদলে ধৈর্য ও সহনশীলতার রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তরুণ প্রজন্ম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথা বলেছেন। যেহেতু বাংলাদেশের মোট ভোটারের একটি বিশাল অংশ তরুণ, যারা ২০০১-২০০৬ মেয়াদের রাজনীতি দেখেনি। তাদের কাছে তারেক রহমানকে নিয়ে যে নেতিবাচক বয়ান রয়েছে, তা ভাঙা তার অন্যতম বড় লক্ষ্য। তিনি এখন ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ এবং ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ গড়ার কথা বলছেন। এই আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি যদি তিনি শুধু বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ না রেখে দলীয় কাঠামোতে প্রয়োগ করতে পারেন, তবেই দেশের রাজনীতিতে প্রকৃত গুণগত পরিবর্তন আসবে।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ঘিরে একদিকে যেমন প্রবল জনজোয়ার তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে জনমনে রয়েছে গভীর কৌতূহল ও প্রত্যাশা। দীর্ঘ ১৭ বছরে বদলে যাওয়া তারেক রহমান নিজের দক্ষতাকে ধরে রেখে রাজনীতিকে একটি সুন্দর কাঠামো দিতে কতটুকু সক্ষম হবে—সে নিয়েও আলোচনা চলছে। কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। তারেক রহমানের প্রতিটি পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে—বাংলাদেশ কি আগের মতোই বৃত্তাকার পথে ঘুরবে, নাকি সত্যিকারের এক ‘নতুন বাংলাদেশ’ দেখবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি ঐতিহাসিক এবং রাজসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হয়েছে। তার প্রত্যাবর্তনে বিএনপি আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের হৃদয়ের আনন্দ এবং আকুতি প্রকাশ করেছেন। সারা দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের বদৌলতে তারেক রহমানের এই রাজসিক প্রত্যাবর্তন সারা দেশের মানুষ আনন্দ নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে উপভোগ করেছেন।
তিনি বলেন, দেড় যুগ পর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেবল বিএনপি এবং তার নেতাকর্মীদের দারুণভাবে উজ্জীবিত উৎসাহিত করেছে—তা নয়, বরং এই দেশের গণতন্ত্রকামী স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে। তিনি এমন একটা সময়ে দেশে এসেছেন, যখন এই বাংলাদেশ একটি চরম রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতি অতিক্রম করছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় করা নাড়ছে। সেই সময়ে তারেক রহমানের এই সশরীরে এসে উপস্থিতি এটি যেমন বিএনপির সাংগঠনিক এবং আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা দারুণ প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে এই দেশের গণতন্ত্রকে টেকসই এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের এ উপস্থিতি এই দেশের মানুষের জন্য আমি মনে করি একটি আশীর্বাদ স্বরূপ।
ছিদ্দিকুর রহমান খান আরও বলেন, তারেক রহমান তার বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে রাজনৈতিক লিগ্যাসি বহন করছেন এবং দীর্ঘদিন তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আগামী দিনে শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষাই করবেন না, বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক এবং নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি সফল হবেন। একই সঙ্গে তারেক রহমানের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন রাজনীতিতে শান্তির বার্তা নিয়ে আসবে এবং গণআকাঙ্ক্ষার দেশ গঠনে নেতৃত্ব দেবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. স ম আলী রেজা কালবেলাকে বলেন, অস্থির সময়ে তারেক রহমানের রাজসিক প্রত্যাবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক দিক। তার কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক। কারণ, দীর্ঘমেয়াদের ফ্যাসিবাদী শাসনে বাংলাদেশ এখন ভঙ্গুর। এখানে অনেক কিছুই ঠিক নেই। ফলে লন্ডনে বসে দীর্ঘদিন তারেক রহমান যে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার একটা রিফ্লেকশন (প্রতিচ্ছবি) দল পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। আগামীতে দেশ পরিচালনায়ও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেবেন বলে বিশ্বাস করি।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চব্বিশোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমান একজন অবিসংবাদিত অপরিহার্য নেতা। দেড় যুগ পর তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক অগ্রগতি, গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন ও সুদৃঢ়করণ এবং একটি সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিকাশে তিনি কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে জনপ্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবেন। সংবর্ধনা মঞ্চে দেওয়া তারেক রহমানের বক্তব্য দেশের মানুষকে আশা জাগাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।