Image description

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কুষ্টিয়ায় ফের সক্রিয় হচ্ছেন চরমপন্থিরা। তাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে আশ্রয় খুঁজছেন। ভোট বাড়ানোর আশায় রাজনৈতিক নেতারাও চরমপন্থিদের দলে ঠাঁই দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে দুজন শীর্ষ চরমপন্থি নেতার নাম এখন আলোচনায়। 

বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির এক সময়ের শীর্ষ চরমপন্থি নেতা আব্দুল লতিফ লাট্টু এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে শোরগোল ফেলেছেন। অস্ত্র-গুলিসহ র‍্যাবের হাতে আটক হয়ে কয়েক বছর কারাগারে থাকা লাট্টু এখন দলটির প্রচারণায় নেমেছেন। গণমুক্তি ফৌজের শীর্ষ চরমপন্থি নেতা জাহাঙ্গীর কবির লিপটন এখন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কুষ্টিয়া-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকার, আর জামায়াত থেকে নির্বাচনে লড়বেন মুফতি আমির হামজা। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের  মুফতি আব্দুল লতিফ ও গণঅধিকারের আব্দুল খালেক ভোটের মাঠে আছেন। বিএনপি ও জামায়াত সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছে প্রচারণায়। ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী জাকির হোসেন সরকার উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি সবুজ উপজেলা গড়ার কথা জানিয়েছেন। আর দাঁড়িপাল্লার সম্ভাব্য প্রার্থী আমির হামজা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি সড়ক-অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভোটারের কাছে যাচ্ছেন। 

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খন্দকার রশিদুজ্জামান দুদু এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর সর্বশেষ বিতর্কিত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মাহবুবউল-আলম হানিফ এমপি নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬ সালে বিএনপি নেতা আব্দুল খালেক চন্টু এবং ২০০১ সালে বিএনপি নেতা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন এমপি হয়েছিলেন।  

বিএনপি ও জামায়াতের দুই প্রার্থীর প্রচারণায় চরমপন্থিরা ভূমিকা রাখছেন বলে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। দেশের বাইরে পালিয়ে থাকা দুই শীর্ষ চরমপন্থি নেতাও প্রার্থীদের পক্ষে কলকাঠি নাড়ছেন। 
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম-খুন ও অস্ত্র ব্যবসা করে আলোচিত লিপটন এখন বিএনপির নেতাদের সঙ্গে ভিড়েছেন। সরকার পতনের পর কারাগারে থাকলেও এখন জামিনে আছেন লিপটন। তিনি বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে জামায়াত নেতারা অভিযোগ করেন। আর 

লাট্টু জামায়াতের হয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ বিএনপির। স্থানীয়রাও মনে করেন, কুষ্টিয়া-৩ আসনে বিএনপি-জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে এই দুই চরমপন্থি নেতা কাজ করছেন। 

পুলিশ ও এলাকাবাসীর তথ্য অনুযায়ী, লাট্টুর বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের উজান ইউনিয়নের দূর্বাচারা গ্রামে। লাট্টু দীর্ঘ সময় বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির খুলনা বিভাগের সামরিক কমান্ডার ছিলেন। অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন কয়েকবার। কারাগারে ছিলেন দীর্ঘ সময়। সর্বশেষ গত বছর ১২ জুলাই তাঁকে অস্ত্র, গুলিসহ আটক করে র‍্যাব। পরে জামিনে ছাড়া পান। 

একই এলাকায় বাড়ি আরেক চরমপন্থি নেতা লিপটনের সঙ্গে বিরোধ থাকায় জামায়াতে যোগ দেন লাট্টু। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাহবুবউল-আলম হানিফের আশ্রয়ে থাকা লিপটন বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন। গত জুলাইয়ে আটক হওয়ার আগে লিপটনকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। এখন জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজেকে কিছুটা লুকিয়ে রেখেছেন। 

এলাকা ঘুরে কথা হয় বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে। এর মধ্যে এক সার ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লাট্টু চরমপন্থি নেতা। ভোল পাল্টে বাঁচার জন্য জামায়াতের সঙ্গে ওঠাবসা করছেন। প্রকাশ্যে জামায়াতের হয়ে ভোটের মাঠে না নামলেও গোপনে কাজ করছেন। তাঁর একটা বলয় আছে।

উজানগ্রাম ইউনিয়ন জামায়াতের আমির হায়দার আলী বলেন, লাট্টু আমাদের দলে যোগ দিয়েছেন। আমাদের সভা-সমাবেশে আসছেন নিয়মিত। কাজ করছেন দলের জন্য। তবে চরমপন্থি লিপটন ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে প্রভাব বিস্তার করছেন।

এ ব্যাপারে আব্দুল লতিফ লাট্টু বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। আমার সমাজের লোকজন এলাকায় নিগৃহীত হয়ে আসছিল। জামায়াত তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে জামায়াতের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক হয়েছে।

তবে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদ বলেন, জামায়াত নেতা হায়দার আলী যেসব অভিযোগ করেছেন, তা মিথ্যা। চরমপন্থিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। আমাদের প্রার্থীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। লাট্টু ও লিপটন কী ধরনের লোক তা সবাই জানে। 

বিএনপি প্রার্থী জাকির হোসেন সরকার বলেন, জামায়াত এখন দ্বিচারিতা নীতি নিয়েছে। লিপটনের সঙ্গে আমার বা দলের সম্পর্ক নেই। সে ছাত্রলীগ করত এক সময়। হানিফের ছত্রছায়ায় ছিল। চরমপন্থি লাট্টুকে তারা দলে নিয়েছে। এটাকে জায়েজ করতে তারা মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের হয়ে অনেক শীর্ষ চরমপন্থি নেতা দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করছে এমন তথ্যও আছে। 

সন্ত্রাসীর বিষয়ে জামায়াত প্রার্থী আমির হামজা বলেন, অবৈধ অনেক অস্ত্র চরমপন্থির হাতে আছে। তারা ভোটে একটি দলের হয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমরা এসব অস্ত্রধারী গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছি। 

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত উন্নয়নে কাজ করছে পুলিশ। কারা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেই তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ধরতে কাজ করছে পুলিশ বাহিনী। সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

এদিকে কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী দলটির উপজেলা সভাপতি সাবেক এমপি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা মাঠে কাজ করছেন। এখানে তাঁর বাবাও তিনবারের এমপি থাকায় বিএনপির বিশাল জনসমর্থন আছে। এ ছাড়া জামায়াতের প্রার্থী উপাধ্যক্ষ বেলাল উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি আমিনুল ইসলাম এবং এনসিপির নুসরাত তাবাসসুম এ আসনে লড়বেন।

কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনে বিএনপির হয়ে লড়ছেন ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী। তাঁর বাবা দুবার এমপি ছিলেন। জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুল গফুর।

বিএনপির আন্তঃকোন্দলের কারণে জামায়াত প্রার্থী কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন। তবে কোন্দল মিটে গেলে বিএনপি প্রার্থীর জন্য সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হবে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলনের মুফতি আরিফুজ্জামান লড়বেন দলের হয়ে। এ ছাড়া এনসিপি থেকে সাংবাদিক ইয়াসির আরাফাত কিংবা নয়ন আহমেদ দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন।

কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে বিএনপির হয়ে লড়বেন সাবেক এমপি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী। এখানে বিএনপির তিনটি বলয় আছে। যার দুটি বলয় মেহেদী রুমীর বিরোধিতা করে মাঠে আছে। জামায়াতের প্রার্থী উপজেলার নায়েবে আমির আফজাল হোসেন ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আনোয়ার খান মাঠে রয়েছেন। এনসিপি থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন যুব অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শাকিল আহমেদ তিয়াস। 

কুষ্টিয়ার চারটি নির্বাচনী আসনে মোট ভোটার ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৫১১ জন। এর মধ্যে পুরুষ আট  লাখ ৬০ হাজার ৯৩৩ এবং নারী ভোটার আট লাখ ৬৫ হাজার ৬৭০ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১৩ জন। ভোটকেন্দ্র ৫৯৯টি।