ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির মধ্যে মনোনয়নজনিত অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছে। দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিভিন্ন জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ‘ধানের শীষ’-এর বিরুদ্ধেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্তত অর্ধশত আসনে বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। দেশ রূপান্তরের তথ্য বলছে, ইতিমধ্যে দলটির অন্তত ১০ জন নেতা ধানের শীষের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বও এ অভ্যন্তরীণ সংকটের চাপে রয়েছে। বিএনপিকে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে এখনই দলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও মাঠপর্যায়ের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্রুত বিভেদ মেটানো না গেলে দলীয় প্রার্থীরা বড় বিপদে পড়তে পারেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘সবাই যাতে একসঙ্গে কাজ করে সেটা নিশ্চিত করতে আমরা সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। একক প্রার্থীর মাঠে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে শিগগির আমরা কঠোর নির্দেশনা দেব। ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে না থাকলে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে দল।’
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আসনে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একাধিক বিদ্রোহী দাঁড় করিয়ে মাঠে রাখতে চায় একটি বিশেষ মহল। বিদ্রোহী প্রার্থীদের পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা খরচের পরিকল্পনা করে মহলটি কাজ শুরু করেছে। এমন ষড়যন্ত্রের কথা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জানার পর মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগপর্র্যন্ত প্রায় প্রতিদিন গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রার্থিতার বিরোধ মেটানোর কাজ হয়েছে। এজন্য বিএনপি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একটি কমিটিও করে দিয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়নজনিত বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। যারা মাঠে দলের সুনাম নষ্ট করবে, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করবে, বিদ্রোহী মনোভাব দেখাবে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে কিছু আসনে দলটির প্রার্থী পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে শীর্ষ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত মাগুরা-২, নারায়ণগঞ্জ-৪, ফরিদপুর-১, গাজীপুর-৩, পাবনা-৩, নড়াইল-১, সুনামগঞ্জ-৩, সুনামগঞ্জ-৪, নাটোর-১, পটুয়াখালী-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা ধানের শীষের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
মাগুরা-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও এ আসনের তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল। গত ১৮ নভেম্বর বিকেলে শালিখা উপজেলা বিএনপির (একাংশের) উদ্যোগে আড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তার মনোনয়নের দাবিতে আয়োজিত জনসভায় তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন না মিললে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেব।’ এ আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে নিতাই রায় চৌধুরীকে ধানের শীষের মনোনয়ন দেওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী। তিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক। ১৯৯৬ সালে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী হন তিনি। গত ২৯ নভেম্বর সদর উপজেলার বক্তাবলী ইউনিয়নে ‘বক্তাবলী গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে এক স্মরণসভায় সভাপতির বক্তব্যে আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
ফরিদপুর-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন রাজ্জাক জুট মিলের কর্ণধার ও বিএনপি ঘরানার ব্যবসায়ী সাবেক ছাত্রদল নেতা আবুল বাশার খান। ২৮ নভেম্বর রাতে মধুখালী উপজেলার আশাপুর এলাকায় রাজ্জাক জুট মিলে জেলা ও তিন উপজেলার গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ ঘোষণা দেন। একইভাবে গাজীপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন এনামুল হক মোল্লাহ। তিনি শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সৌদি আরবের মক্কা মিছফালাহ শাখা বিএনপির সভাপতি। সম্প্রতি তিনি অস্ত্রসহ আটক হয়েছেন যৌথ বাহিনী হাতে।
গত ২১ নভেম্বর পাবনা পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চাটমোহর উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের একাংশের সংক্ষিপ্ত পথসভায় বক্তব্য রাখেন সাবেক এমপি ও চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কেএম আনোয়ারুল ইসলাম এবং সাবেক সদস্য সচিব ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাসাদুল ইসলাম হীরা। পাবনা-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে হাসাদুল ইসলাম হীরা বলেন, ‘স্পষ্ট বলে দিতে চাই, দল যদি প্রার্থী পরিবর্তন না করে তাহলে আপনারা নিশ্চিত থাকেন, হয় চাচা, না হয় ভাতিজা, আমরা যেকোনো একজন নির্বাচন করব।’ এ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন। নড়াইল-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এসএম সাজ্জাদ হোসেন। ২০১৮ সালে বিএনপি তাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনে দলের মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক উপজেলা ও পৌরসভার চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়বেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। তারা জানান, শিগগির সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেবেন তিনি। এ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম নুরুলের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। সুনামগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেন। গত বুধবার রাতে গণমাধ্যমকে তিনি এ কথা জানান। এ আসনে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমদের নাম ঘোষণার দুদিনের মাথায় আনোয়ার হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
নাটোর-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাইফুল ইসলাম টিপু। ৮ নভেম্বর রাতে নিজ বাড়ির সামনে এক অনানুষ্ঠানিক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘নিজেদের পক্ষে মনোনয়ন আনতে সবাইকে মাঠে নামতে হবে। আমি যদি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করি, ইনশাআল্লাহ, বিজয় আমার হবে।’
পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাসান আল মামুন। তিনি নিজেই বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে ফেসবুকের মাধ্যমে গলাচিপা-দশমিনায় দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার কথা ছিল হাসান মামুনের। শেষ পর্যন্ত গোলাম মাওলা রনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৪ ডিসেম্বর ৩৬ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। এর আগে ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রথম পর্যায়ে ২৩৭ আসনের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছিল। একদিন পর মাদারীপুর-১ আসনের ঘোষিত প্রার্থীর নাম স্থগিত করা হয়েছিল। এ হিসাবে মোট ২৭২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। বাকি ২৮ আসনের তালিকা ‘যথাসময়ে’ ঘোষণা করা হবে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যারা আছেন, তাদের বিষয়ে আমাদের দুই-একটা ডিসিশন হবে, সেগুলো আরও পরে ঘোষণা করব। বাকিগুলো আমরা যথাসময়ে ঘোষণা করব।’