Image description
 

ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত নেতা হারুন (ছদ্মনাম) প্রভাবশালী লোক ছিলেন। তার কথায় প্রশাসন উঠত-বসত। ৫ আগস্টের পর তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। পাঁচ মাসের মাথায় স্ত্রী ও সন্তানদেরও সেখানে নিয়ে যান। কলকাতার নিউটাউনে বাস করছেন তিনি। মাসখানেক আগে তিনি সপরিবারে লন্ডনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় যেতে পারেননি। একই ঘটনা ঘটেছে পুলিশের একজন অতিরিক্ত ডিআইজির বেলায়ও। বাধ্য হয়ে ফিরতে হয়েছে তাদের।

এ দু'টি ঘটনায় আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তারা বেশ আতঙ্কিত। বিষয়টি বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। এই প্রতিবেদক কয়েকজন পলাতক নেতা ও পুলিশ কর্তার সঙ্গে কথা বলেও এ তথ্যের সত্যতা পেয়েছে।

পুলিশের সূত্রটি জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। সাবেক মন্ত্রী-এমপিরাও এ তালিকায় আছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ছেন সাবেক সরকারের কিছু মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা এবং পুলিশের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও চলছে। অনেক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা অন্যান্য দেশেও গেছেন। অধিকাংশ নেতাকর্মীই বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে চলে গেছেন।

কেউ কেউ বিমানবন্দর দিয়েও গেছেন। ভারতে যারা গেছেন তাদের অনেকেই কলকাতায় আছেন। নেতাদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন। পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের এবং জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাও আছেন। যারা কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আছেন, তাদের তালিকা আছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তাদের ওপর ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও নজর আছে। তারা বেশিরভাগ সময়ই বাসাবাড়িতে থাকছেন। মাঝেমধ্যে রাতের বেলায় নেতা বা পুলিশকর্তারা বাসা থেকে বের হন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। কলকাতায় যারা আছেন, তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিত করেছে কলকাতা পুলিশ।

হদিস মিলছে না আসাদুজ্জামান খানের
কলকাতায় অবস্থান করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা টেলিফোনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা অন্য দেশে যেতে চাইলেও পারছেন না। কলকাতার লোকজন আমাদের সহায়তা করলেও অনেকে আর্থিক সমস্যার মধ্যে আছেন। ভারত সরকারের সিগন্যাল ছাড়া যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেন যেতে দেওয়া হচ্ছে না তাও বুঝতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ফাঁসির রায় হওয়ার পর তাকে প্রকাশ্য দেখা যাচ্ছে না। তিনি কোথায় আছেন বলা যাচ্ছে না। রায় ঘোষণার আগের দিনও তাকে নিউ মার্কেট এলাকায় দেখা গেছে। তবে তিনি ভারতেই আছেন; অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।’

একই রকম কথা জানিয়ে পুলিশের একজন অতিরিক্ত ডিআইজি। তিনি টেলিফোনে বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পর ভয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার একটি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে আসি। এখন অন্য দেশে চলে যেতে চাই। কিন্তু পারছি না। এ দেশের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখানে টুকটাক চাকরি করলেও অর্থের অভাব রয়েছে। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ থেকে টাকা আনতে হচ্ছে।

ভারতেও ‘প্রচ্ছন্ন আত্মগোপন’
পুলিশ সূত্র জানায়, আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতা নিজেদের নিষ্ক্রিয় বলে দাবি করছেন, তবু বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে, কলকাতায় বসে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কলকাঠি নাড়ছেন। নেতাকর্মীরা হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের মাধ্যমে ‘আত্মগোপনে’ থাকা নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পাচ্ছেন। সূত্র আরও জানিয়েছে, ভারতে পলাতক নেতারা অর্থ শেষ হয়ে যাওয়া, পাসপোর্ট না থাকা বা ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার মতো সমস্যায় রয়েছেন। কেউ কেউ অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কলকাতা পুলিশের নজরদারি তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ভারতে থেকেও ‘প্রচ্ছন্ন আত্মগোপনে’ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা নেতাদের বেশিরভাগ শহরাঞ্চলের বাইরের থাকছেন। কেউ শহরে হোটেল বা বাসা ভাড়া করে থাকছেন। দিনের বেলায় তারা বের হন না। রাতে আড্ডা দেন বিভিন্ন স্থানে।

সহস্রাধিক নেতাকর্মী কলকাতায়
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, শুরুতে পলাতকদের একটা বড় অংশের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। সম্প্রতি বিদেশে অবস্থানরত দলীয় নেতাদের একটি খসড়া তালিকা করেছে দলটি। তালিকা অনুযায়ী, প্রায় দুই হাজার নেতা ভারত, নেপাল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সহস্রাধিক নেতাকর্মী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, যাদের বড় অংশই রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। ওই নেতারা বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, গুগল মিটের মাধ্যমে বিভিন্ন অনলাইন বৈঠক করা হয়। আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

কলকাতায় গিয়ে পুলিশের তথ্য কানেকশন
পুলিশ সূত্র জানায়, মাসখানেক আগে পুলিশের একটি ইউনিট গোপন প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। প্রতিবেদন তৈরি করার আগে ওই ইউনিটের চারজন কর্মকর্তা কলকাতায় গিয়ে পলাতকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। সপ্তাহখানেক তারা কলকাতায় অবস্থান করে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা টেন্ডার-বাণিজ্য, দুর্নীতিসহ এমন কোনো কাজ নেই যা করেননি। শিক্ষার্থীদের ওপর তারা দফায় দফায় হামলা চালিয়েছেন।

পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কম যায়নি। তারাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। সরকার পতনের পর তাদের দাম্ভিকতা ধসে পড়ে। পালানোর পথ খোঁজেন তারা। সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনেকে ভারতে পালিয়ে যান। দালালদের মাধ্যমে তারা দেশের বাইরে যান। দেশত্যাগের জন্য তারা যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, ফেনী, সিলেট, দিনাজপুরের হিলি ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা, আগরতলা, কলকাতা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে যান।

কলকাতা ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা অন্য দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন নিখিল, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ ও যুবলীগ নেতা জয়দেব নন্দী।

কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ পুলিশের সোর্স
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তথ্যানুযায়ী সহস্রাধিক নেতাকর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তা কলকাতাসহ বিভিন্ন প্রদেশে আছেন। তাদের বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ নিচ্ছি। তারা কোন হোটেল বা বাসায় অবস্থান করছেন, সে তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। কলকাতায় আমাদের সোর্স লাগানো আছে।’

কলকাতার মারকুস ও সদর স্ট্রিট এলাকার দুটি হোটেলের দুই ম্যানেজার গত মঙ্গলবার রাতে বলেন, গত বছর ২ আগস্ট থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা কলকাতায় এসেছেন। ৫ আগস্টের পর নেতাকর্মীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা নিউ মার্কেট, নিউ টাউন, মুকুন্দপুর, মারকুস স্ট্রিট এবং শহরের বাইরে অবস্থান করছেন। ভারতের অন্য প্রদেশেও নেতারা আছেন।

দক্ষিণ কলকাতায় যেসব জায়গায় স্বল্প মূল্যে বাসাবাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় সেগুলোর অন্যতম গড়িয়া। ওইসব এলাকায় বাংলাদেশের লোকজন বেশি। তারা বলেন, প্রতিদিনই কলকাতার পুলিশ হোটেলে আসে। বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয় বেশি। তারা সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখছে বাংলাদেশিদের। তবে কাউকে হয়রানি করছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা আছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হয়রানি না করার।

শীর্ষনিউজ