মায়ের জন্য সন্তানের অপেক্ষা। দিন সপ্তাহ পার হলেও শেষ হচ্ছে না সময়। লন্ডন থেকে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কবে বাংলাদেশ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে লন্ডনযাত্রায় সঙ্গী হতে ঢাকায় এসেছেন পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান। শাশুড়ির শয্যার পাশে থেকে স্বাস্থ্যসেবাসহ সার্বিক তদারকি করছেন তিনি। তারেক রহমানও স্ত্রীর মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে মায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন। গত ২৩শে নভেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া।
চিকিৎসকরা জানান, তার ফুসফুসে ইনফেকশন ধরা পড়ায় তিনি বর্তমানে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য সিসিইউতে (ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট) স্থানান্তর করা হয় এবং নিবিড় চিকিৎসা চলমান রয়েছে। ২৭শে নভেম্বর থেকে ‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’সময়ে রয়েছেন তিনি। শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেও চিকিৎসকদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে চিকিৎসা চলছে তার। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়ার এন্ডোস্কপি করা হয়। এছাড়া মাইনর অপারেশনও সম্পন্ন হয়।
মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের অবস্থা এখনো ক্রিটিক্যাল। ঝুঁকিমুক্ত নন। উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। দেশের বাহিরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে এখনো তাঁর শারীরিক অবস্থা তৈরি হয়নি। বিদেশযাত্রায় ১২/১৪ ঘণ্টা জার্নি করার মতো খালেদা জিয়ার সক্ষমতা নেই। পরিবার ও দলের উদ্যেগে বিদেশে নেওয়ার সকল ধরনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। অপেক্ষায় শুধু চিকিৎসকদের গ্রিণ সিগন্যালের। খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডা মুহাম্মদ ইউনুস, তিন বাহিনীর প্রধান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডাক্তার শফিকুর রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি গিয়েছেন। সারাদেশের মানুষের দোয়া মুনাজতে এখনো খালেদা জিয়ার নাম রয়েছে।
তবে রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা কিছু না জানালেও মেডিকেল বোর্ডের এক চিকিৎসক জানিয়েছেন “খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। যেগুলোর রিপোর্ট ভালো এসেছে। এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড চিন্তা করছে তাকে বিদেশ না নিয়ে দেশেই সারিয়ে তোলা যায় কিনা আমরা চেষ্টা করছি, দেশেই চিকিৎসা দিতে। উনার অবস্থা এর চেয়ে বেশি ক্রিটিক্যাল ছিল অতীতে। তখনও সেরে ওঠেছিলেন। দোয়া রাখেন, লন্ডন নেওয়ার প্রয়োজন যেন না হয়। সিটিস্ক্যান, ইসিজিসহ কয়েকটি টেস্ট করা হয়েছে রোববার। সেগুলোর রেজাল্টও ভালো এসেছে ।”
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, এয়ার এম্বুলেন্স কারিগরি ত্রুটির কারণে আসতে পারেনি, এটাও যেমন সত্য কথা। ওই সময়ে জরুরিভাবে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ওই মুহূর্তে উনার ফ্লাই করা সঠিক হবে না। সেজন্য উনাকে বিদেশ নেয়ার বিষয়টি কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে, এয়ার এম্বুলেন্স এখন সবসময় প্রস্তুত আছে। কিন্তু প্রস্তুত থাকলেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা এবং সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অর্থাৎ চিকিৎসাগত দিক থেকে, এটি অত্যন্ত প্রাধান্য পাচ্ছে সর্বত্রই। আমাদের মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন থেকে সম্মানিত চিকিৎসকরা অংশ নিচ্ছেন, সকলে উনার ফিজিক্যাল কন্ডিশনের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বহু ত্যাগ স্বীকার করে ও নানা নির্যাতন সহ্য করে দেশবাসীকে ভালোবেসেছেন এবং তাদের জন্যই দেশে থেকেছেন। কোনো পরিস্থিতিই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। সারা বিশ্ব থেকে তার রোগমুক্তি কামনা করা হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে নেতা-নেত্রী মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও তাকে কখনও ভোলে না। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে তার রোগমুক্তিই মুখ্য বিষয়; অন্য কিছু নয়।’
আবারও শাশুড়িকে দেখে গেলেন জুবাইদা রহমান: টানা ১৫ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে। রোববার বিকেলে তাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন তার পুত্রবধূ এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে তিনি হাসপাতালে পৌঁছান, এসময় তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)। হাসপাতালের সামনে যদিও নেতাকর্মীদের তেমন কোনো ভিড় দেখা যায়নি, তবে কিছু পথচারী থমকে দাঁড়িয়ে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খালেদা জিয়ার অবদান- মাহমুদুর রহমান মান্না: নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার অসাধারণ অবদান ছিল।’রোববার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।মান্না বলেন, বেগম জিয়া অনেক কষ্ট করেছেন। অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। সবাই চাই তিনিও এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকুক। তার স্বাস্থ্য বিষয়ে সবার মাঝে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেই কারণে নির্বাচনের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় কী না এটা আমাদের মনের মধ্যে আছে। তবে আমরা চাই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে। আগে নির্বাচন কমিশন বলেছিল চলতি মাসের ৭-৮ তারিখের দিকে তফসিল ঘোষণা করা হবে। তারপর শোনা গেল ১১ তারিখ তফসিল ঘোষণা হবে। এখন পত্রিকায় নির্বাচন কমিশন বলছে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না, আমরা দেখছি। আমরা বলেছি রোজার আগে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন যত বিলম্ব হবে তত শঙ্কা হবে।
সবার আবেগে খালেদা জিয়া: গত ২৭ নভেম্বর দুপুরে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর ছড়িয়ে পড়লে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই এভার কেয়ার হাসপাতালের সামনে শুরু হয় মানুষের ঢল। কোনো রাজনৈতিক শো-ডাউন বা কোনো স্লোগানে এই ঢল সৃষ্টি হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের সম্মান, ভালোবাসা, আবেগ এই ভিড় সৃষ্টি করে। সবার চোখে মুখেই উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। রাতের পর রাত হাসপাতালের সামনে দিন পার করছে সাংবাদিকরাও। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভারকেয়ারের বাইরের এই ভিড় প্রমাণ করে, জনগণ বেগম জিয়াকে আর তার রাজনৈতিক জীবনের জন্য বিচার করছে না; বরং তার ত্যাগ ও দেশের জন্য আপোষহীন চরিত্রের জন্য সম্মান জানাচ্ছে। যখন একজন রাজনৈতিক নিজের জীবনের চেয়ে দেশ, মাটি ও মানুষকে গুরুত্ব দেন, তখন তিনি আর সাধারণ নেতা থাকেন না। হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেগম খালেদা জিয়া আজ সেই উচ্চতায় পৌঁছেছেন।
সরেজমিনে এভারকেয়ারে দেখা গেছে, রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাদরাসার ছাত্র, শিশু, কর্পোরেট চাকরিজীবী মোট কথা সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করছেন। তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, এমন একটি খবর শোনার জন্য মানুষ দিনের পর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন; এমন দৃশ্য বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য দেখা যায়নি। এটিই প্রমাণ করে, বেগম খালেদা জিয়া আপামর জনসাধারণের আবেগে পরিণত হয়েছেন।