দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি সংসদীয় আসনে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এলডিপির পৃথক প্রভাব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই তিন পক্ষের অবস্থান, সম্ভাব্য জোট, শরিক-সমঝোতা এবং অভ্যন্তরীণ চাপ-টানাপড়েন ভিন্ন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। বিএনপি ছয়টির মধ্যে চার আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তবে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) এবং চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন দুটিতে এখনও প্রার্থী দেয়নি। দুই আসনেই এলডিপির সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে এলাকায় জোর আলোচনা চলছে। এই সম্ভাব্য সমঝোতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীও ছয় আসনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে মাঠে নেমেছে, যাদের লক্ষ্য অন্তত দুই আসনে নিশ্চিত জয়। অতীত নির্বাচনের ফল, নানা সময়ের প্রভাববলয়, স্থানীয় পর্যায়ের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, হেফাজত ও এনসিপির কার্যক্রমÑ সব মিলিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি আসনই এখন বিরোধী রাজনীতির সবচেয়ে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এলাকা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) ও চট্টগ্রাম-১৫ আসনে এখনও প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। ধারণা করা হচ্ছে, আসন দুটি বিএনপির শরিক দল এলডিপিকে ছাড় দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটিতে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং অপরটিতে তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক নির্বাচনী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) : এ আসনে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর নাম ঘোষণা করেছে। এ আসনে জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী ডা. এম এ নাসের। ১৯৯১ সালে এ আসনে বিএনপির সিরাজুল ইসলাম জয়ী হন এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জয় পান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। গত ৫ নভেম্বর নির্বাচনী প্রচারে হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এরশাদ উল্লাহ বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। একই ঘটনায় সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা নিহত হন। এখানে এনসিপির প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক জোবাইরুল আরিফ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) : আসনে বিএনপি এনামুল হককে মনোনয়ন দিয়েছে। ২০১৮ সালেও তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এ আসনে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। এনামুল হকের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কোন্দল রয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের ১৪টি গাড়ি সরানোর কাজটি করেন এনামুল হকসহ কয়েকজন বিএনপি নেতা। ওই ঘটনার পর দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। পদ হারান দক্ষিণ জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক ও কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মামুন মিয়া। এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়া ও সাবেক এমপি গাজী শাহজাহান জুয়েল।
এনামুল হক বলেন, আমি এলাকায় সর্বদা সক্রিয় ছিলাম। এখন প্রাথমিক গণসংযোগে মানুষের জোয়ার দেখতে পাচ্ছি। মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্য দুই নেতা ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবেন বলে আমাকে কথা দিয়েছেন। এস আলম ঘটনার পর দলীয় পদ হারানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলের সিদ্ধান্তের প্রতি তিনি সর্বদা অনুগত। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ডা. ফরিদুল আলম। এনসিপির দক্ষিণ জেলা যুগ্ম সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন এবং হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদীও মাঠে সক্রিয় আছেন।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) : আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির সরওয়ার জামাল নিজাম। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে পরাজিত করে চমক দেখান। এবারও নিজাম বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস ও সদস্য সচিব হেলাল উদ্দিনও এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে আনোয়ারায় একাধিকবার মশাল মিছিল ও সড়ক অবরোধও হয়েছে। মনোনীত প্রার্থী সরওয়ার জামাল নিজাম বলেন, আমি জীবনে কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি, চাঁদাবাজি করিনি। দল আমাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দিয়েছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে আমি ও আমার দল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, অতীতে আমরা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছি। ফলে এখানে সবসময় বিএনপির প্রার্থীকে জয়ী করতে যা করা দরকার করেছি। এবার আমরা জয়ের ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) : আসনে বিএনপির প্রার্থীর তালিকা বেশ দীর্ঘ। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক বিচারপতি ও ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সালাম মামুন, বিএনপির নির্বাহী সদস্য ডা. মহসিন জিল্লুর করিম; চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, বিএনপি নেতা আরাফাত কোকো, নুরুল আনোয়ার ও শফিকুল ইসলাম রাহি। এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এ আসন থেকে পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য থাকায় তিনি প্রভাবের বলয় তৈরি করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও রাতের ভোটে হেরে যান। এবার শরিকদের জন্য আসনটি ছেড়ে দেবেÑ এমন প্রচার চলছে এলডিপিতে। এ অবস্থায় প্রার্থী হতে পারেন অলি আহমদের ছেলে ওমর ফারুক। তবে স্থানীয় বিএনপি বলছে, তারা এ ধরনের কোনো বার্তা কেন্দ্র থেকে পায়নি। মনোনয়নপ্রত্যাশী নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ আসন শরিককে ছাড়ার কোনো নির্দেশ আমরা পাইনি। আমি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) : আসনটি নানা কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯১ সালে এ আসনে প্রথম নির্বাচিত হন জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী। ১৯৯৬ সালে জয়ী হন তৎকালীন বিএনপি নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। ২০০১ সালে আবার বিজয়ী হন জামায়াতের শাহজাহান চৌধুরী। ২০০৮ সালে জামায়াত এ আসনে মহানগরের তৎকালীন আমির আ ন ম শামসুল ইসলামকে মনোনয়ন দেয়, যিনি অলি আহমদকে পরাজিত করে জয় পান। আগামী নির্বাচনেও শাহজাহান চৌধুরীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। তিনি বলেন, ‘আমি সারাজীবন সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার মানুষের সঙ্গে ছিলাম ও আছি। দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে, ইনশাআল্লাহ আমরা জয়ের ধারা অব্যাহত রাখব। তবে কেন্দ্রে সক্রিয় আছেন আ ন ম শামসুল ইসলাম, যার কারণে জামায়াতের ভেতরে চাপা উত্তেজনা রয়েছে। সম্প্রতি তার কিছু বক্তব্য নিয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। আসনটি নিয়েও বিএনপি-এলডিপি সমঝোতার কথা প্রচলিত রয়েছে। এমন হলে এখানে প্রার্থী হতে পারেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
চট্টগ্রাম-১৬ : আসনে বিএনপির প্রার্থী নতুন মুখ মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা। তিনি সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে। বাবার জনপ্রিয়তাই তার রাজনৈতিক মূল শক্তি। তবে এ আসনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলী চৌধুরী এখনও মনোনয়ন দাবি ত্যাগ করেননি। তিনি মাঠে সক্রিয় এবং কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণে নানা কর্মসূচি দিচ্ছেন।
এ আসনের জামায়াত প্রার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছি, কিন্তু কাজ করি সর্বদলীয়। ভোটও সর্বদলীয় পাব। আমরা জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। এনসিপি থেকে মীর আরশাদুল হক এবং ইসলামী আন্দোলনের ফরিদ আহমেদ আনসারীও মাঠে সক্রিয় আছেন।
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহায়তা করেছেন আমাদের সময়ের চন্দনাইশ প্রতিনিধি নাসির উদ্দিন, আনোয়ারা প্রতিনিধি ইকবাল বাহার ও বাঁশখালী প্রতিনিধি আবদুল মতলব।