সোমবার রাতে চারজনের একজন হাসিবুল ইসলাম (১৬) তার বাবার মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সঙ্গে সফিকুল, মো. রায়হান, ও হাবিবুর রহমানকে নেয়। পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলটির একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই হাসিবুল ইসলাম মারা যায়। এরপর গতকাল সফিকুল ও রায়হানেরও মৃত্যু হয়।
‘একটাই মাত্র ছেলে ছিল আমার। এ ছেলে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। পড়ালেখা করবে, ভালো চাকরি-বাকরি করবে, পরিবারের হাল ধরবে; কিন্তু সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। এখন আমি কীভাবে বাঁচব, কীভাবে ছেলের কথা ভুলে থাকব, আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন রিমা আক্তার (৩৫)। সড়ক দুর্ঘটনায় গতকাল বুধবার সকালে তাঁর ছেলে সফিকুল ইসলামের (১৬) মৃত্যু হয়েছে। সে নোয়াখালীর চাটখিলের বদলকোট উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। একই ঘটনায় তার আরও দুই সহপাঠীর মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ও মধ্য বদলকোট গ্রামের বাসিন্দা ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নিহত ব্যক্তিরা বিদ্যালয়টির মাধ্যমিক (এসএসসি) নির্বাচনী পরীক্ষার্থী ছিলেন। সোমবার রাতে চারজনের একজন হাসিবুল ইসলাম (১৬) তার বাবার মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সঙ্গে সফিকুল, মো. রায়হান ও হাবিবুর রহমানকেও নেয়। পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলটির একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই হাসিবুল ইসলাম মারা যায়। এরপর গতকাল সফিকুল ও রায়হানেরও মৃত্যু হয়। তবে সঙ্গে থাকা আরেক সহপাঠী হাবিবুর রহমান তেমন আহত হয়নি।
একই সঙ্গে তিন সহপাঠীর মৃত্যুতে পুরো গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গতকাল সফিকুল ইসলামের বাড়িতে ঢুকতেই জরাজীর্ণ টিনশেড একটি ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ডাক দিয়ে পরিচয় দিতেই ঘরের দরজা খুলে দেন বাবা মো. মানিক। তিনি পেশায় নির্মাণশ্রমিক। ঘরের ভেতরে খাটের ওপর বসেই ছেলের কথা বলে বিলাপ করছিলেন মা রিমা আক্তার।
ছেলের সঙ্গে শেষ কথোপকথনের কথা মনে করে রিমা আক্তার বলেন, ‘ছেলে বলেছিল, মা চা খেয়ে আসি, মস্তান নগরের একটি দোকানের চা আমার ছেলের পছন্দ ছিল। এরপর আর কোনো খবর পাইনি। হঠাৎ একজন আমাদের দুর্ঘটনার খবর দেয়। এরপর ছেলে লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে।’
‘জানতে পারলাম, আমার ছেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ছুটে গিয়ে দেখি ছেলে ততক্ষণে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, না–পারলাম কথা বলতে, না–পারলাম কোলে নিতে।’হাসিবুলের বাবা হারুনুর রশিদ
বইগুলো টেবিলে, নেই শুধু তারা
গতকাল রাতে নিহত হাসিবুলের ঘরে ঢুকতেই প্রথম চোখে পড়ে পড়ার টেবিলটি। নিচের তাকজুড়ে সারি সারি সাজানো বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের বই; টেবিলের ওপরেও খোলা পড়ে আছে দুই-তিনটি খাতা। বাজার থেকে ফিরে আবার পড়তে বসবে এমন প্রতিশ্রুতিও ছিল হাসিবুলের। তবে সে আর নেই।
একই দৃশ্য দেখা যায় মো. রায়হান ও সফিকুল ইসলামের বাড়িতেও। তবে তাদের স্বজনেরা এসব বই সরিয়ে রেখেছেন। কারণ, বই-খাতায় চোখ পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন নিহত ব্যক্তিদের মা ও বাবারা।
জানতে চাইলে হাসিবুলের বাবা হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার পরীক্ষা দিয়ে এসে সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে বের হয়েছিল। রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাইনি। পরে জানতে পারলাম আমার ছেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ছুটে গিয়ে দেখি ছেলে ততক্ষণে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। না–পারলাম কথা বলতে, না–পারলাম কোলে নিতে।’
সেদিনের দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান হাবিবুর রহমান। জানতে চাইলে সে বলে, সেদিন হাসিবুল মোটরসাইকেল কিছুটা বেপরোয়াভাবে চালাচ্ছিল। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলটির সোজা বাঁ পাশের একটি গাছে ধাক্কা লাগে। ধাক্কায় মোটরসাইকেল উল্টে তিন বন্ধু গাছের ওপর ছিটকে পড়ে, আর সে সড়কে পড়ে। এ কারণে সে বেঁচে যায়।