Image description
 

আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে। নির্বাচন সামনে রেখে সমমনা দলগুলো নিয়ে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে জোটের শরিক দলগুলোও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে গতি এনেছে। জামায়াতে ইসলামী একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে—তাদের টার্গেট ন্যূনতম ১৫০টি আসনে জয়লাভ করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সমমনা দলগুলো নিয়ে আসন সমঝোতার আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী। এখন একটি সমন্বয় কমিটি শেষবারের মতো মাঠপর্যায়ে জরিপ করছে। কোন দলের কাকে মনোনয়ন দিলে জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর যোগ্যতা ও জয়ের সম্ভাবনার বিচারে সমমনা দলগুলো থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। এ নিয়ে দরকষাকষিও শেষ পর্যায়ে। চলতি মাসে না হলেও আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। তবে যে আসনে যার জয়ের সম্ভাবনা আছে, তিনিই মনোনয়ন পাবেন—তিনি যে দলেরই হোন না কেন।

অবশ্য জামায়াত এবং তাদের শরিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ‘প্রচলিত জোট’ গঠিত হয়নি, বরং এটি একটি ‘নির্বাচনী বা আসনভিত্তিক সমঝোতা’র ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কৌশল হিসেবে চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

কয়েকটি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কালবেলাকে জানিয়েছেন, জামায়াতসহ আটটি দল নিয়ে গঠিত সম্ভাব্য জোটের নির্বাচনী প্রস্তুতি দ্রুত এগোচ্ছে। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন এবং নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে জয়লাভের জন্য শরিকদের মধ্যে একটি কার্যকর সমঝোতা স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছে জোটের শীর্ষ নেতৃত্ব। এ মুহূর্তে আসন ভাগাভাগি, অভিন্ন নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি এবং সম্মিলিতভাবে প্রচার চালানোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। জোটের সম্মিলিত প্রস্তুতি এবং এককভাবে দলগুলোর নিজেদের নির্বাচনী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আটটি দলেরই প্রার্থী তালিকা শিগগির চূড়ান্ত করা হবে।

নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই আসন সমঝোতার প্রক্রিয়া শেষ করার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বেশ আগেই দলীয় প্রার্থীর নাম স্থানীয়ভাবে ঘোষণা করেছে। এখন যেহেতু অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে, এখানে আলাপ-আলোচনার অনেক বিষয় আছে। সেসব বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণের ভোটে জামায়াতে ইসলামী শতাধিক আসনে জয়লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশকিছু দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি দল যুগপৎভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলো হলো—ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। দলগুলোর মধ্যে ছয়টিই ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কেন্দ্র করে এই আট দলের সঙ্গে আরও দু-একটি দল যুক্ত হতে পারে।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বছর খানেক আগেই প্রায় ৩০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলামী। পরবর্তী সময়ে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ একাধিক নেতা জানান, ওই তালিকা চূড়ান্ত নয়। দলটির নীতিনির্ধারকরা সমমনা দলের সঙ্গে জোট কিংবা সমঝোতার ইঙ্গিতও আগেই দিয়েছেন। তবে অন্তত পাঁচটি আসনে অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে প্রার্থী ঘোষণা করেনি দলটি। সম্প্রতি সেসব আসনেও প্রার্থী দেওয়া হয়েছে বলে জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা জানান। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গত ৩ অক্টোবর খুলনায় এক সমাবেশে শরিকদের জন্য ১০০ আসন ছাড়ের কথা বলেন। যদিও তার ওই বক্তব্যকে এখন ‘ব্যক্তিগত’ বলে দাবি করছেন জামায়াতের নেতারা। সেক্রেটারি জেনারেলের ওই মন্তব্যের কারণে জামায়াতের ভেতরে কিছুটা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

শরিকদের জন্য আসন ছাড়ের বিষয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ারের বক্তব্য প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘সেক্রেটারি জেনারেল সমাবেশে যা বলেছেন, সেটি দলীয়ভাবে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে এ মুহূর্তে আসন নিয়ে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতের সমমনা দলগুলো।’

জামায়াতের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চান তারা। ন্যূনতম ১৮৫টি আসনে জয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও অন্ততপক্ষে ১৫০টি আসনে জয়ের জন্য যোগ্য, জনপ্রিয় এবং জেতার মতো প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। দলটি এই বিপুলসংখ্যক আসনে বিজয় নিশ্চিত করতে তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করছে। বিশেষ করে নতুন ভোটার এবং তরুণদের কাছে দলের বার্তা পৌঁছে দিতে কৌশল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থীর নামে ও পক্ষে বিভিন্ন রকমের দলীয় সংগীত ও অন্যান্য প্যারোডি গান বানানো হয়েছে। মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার মাধ্যমে ব্যাপক শোডাউন দিয়েছেন প্রার্থীরা। সম্প্রতি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন দলটির আমির শফিকুর রহমান।

তপশিলের পর প্রার্থী চূড়ান্ত: আট দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত ছয় ক্যাটাগরিতে জরিপ চালিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাদের সমন্বয়ে গোপনে জরিপ করে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই করেছে। এখন আট দলের সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে আরও একটি জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে। জোটের সম্মিলিত প্রস্তুতি এবং এককভাবে দলগুলোর নিজেদের নির্বাচনী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আটটি দলেরই প্রার্থী তালিকা শিগগির চূড়ান্ত করা হবে। চলতি মাসের শেষ দিকে হওয়ায় ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে। এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য হলো—চূড়ান্ত প্রার্থীরা যেন নির্বাচনের আগে থেকেই নিজ নিজ আসনে প্রচারের জন্য যথেষ্ট সময় পান। এরই মধ্যে বেশিরভাগ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি জয়ের সম্ভাবনাকে প্রার্থী বাছাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন কালবেলাকে বলেন, ‘কোন দলের কোন প্রার্থী কোন জায়গায় ভালো অবস্থানে আছেন, সে বিষয়ে আমাদের আলোচনা ও জরিপ চলছে। যে দলের প্রার্থীই হোক না কেন, আমরা এবার জোটের সর্বোচ্চসংখ্যক প্রার্থীকে জিতিয়ে সংসদে যেতে চাই।’

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির মহাসচিব কাজী নিজামুল হক নাঈম কালবেলাকে বলেন, ‘দলগুলোর প্রাপ্য আসন সংখ্যার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি। তার দল থেকে দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখনো কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের একটি সমন্বয় কমিটি কাজ করছে। আট দলের কারও জন্য নির্ধারিত কোনো আসন নেই। যেখানে যার জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে তাকেই সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হবে।’

জাগপার সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের মাঝে এখনো আসন নির্ধারণ বা ভাগাভাগি কোনোটাই চূড়ান্ত হয়নি। এসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।’ জাগপা চারটি আসনে নির্বাচন করবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।