Image description

চলতি মাসে ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিথি ছিলেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক শ কোটি ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিও করেন।

কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমান এমন এক ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানান; যা ট্রাম্পসহ আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও সব সময় চেয়ে এসেছেন। সেটি হলো, সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে পূর্ণ ও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক।

ট্রাম্পের মেয়াদকালে ইসরায়েল সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন (সেপ্টেম্বর ২০২০), মরক্কো (ডিসেম্বর ২০২০) এবং সুদানের (জানুয়ারি ২০২১) সঙ্গে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে সই করে। এটি ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে দূতাবাস খোলার সুযোগ দেয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করে।

ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দখলদারত্ব, গাজা-পশ্চিম তীর-জেরুজালেমে বর্বর দমননীতি এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ইসরায়েলকে বহুদিন ধরে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করেছে। তাই এমন একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক কীভাবে সম্ভব—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

কিন্তু এর পর থেকে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা শুরু করে, লেবাননে হামলা চালায়। ইয়েমেন, ইরান, সিরিয়া ও কাতারেও হামলা চালায়। এতে পুরো অঞ্চলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। যেসব আরব দেশ ইতিমধ্যে চুক্তি করেছে তারা বিপাকে পড়ে, আর যারা নতুন চুক্তি করার কথা ভাবছিল, তারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে থাকে।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠককালে সাংবাদিকদের প্রশ্নে সৌদি যুবরাজ বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, পূর্বাঞ্চলের সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকাটা ইতিবাচক। আমরাও আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের অংশ হতে চাই। কিন্তু দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের (ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকটে) সুস্পষ্ট পথ নিশ্চিত হওয়াও দেখতে চাই।’

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উপস্থিতিতে মেরিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিডে হাত মেলাচ্ছেন মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উপস্থিতিতে মেরিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিডে হাত মেলাচ্ছেন মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক করা’ মানে কী

১৯৪৮ সালে একতরফা ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই আরব প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বহু মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ তাকে বয়কট করে আসছে।

‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ বলতে বোঝায়, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও গোয়েন্দা সহযোগিতা, যোগাযোগ, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন।

তবে অনেকের কাছে ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ শব্দটা সমস্যার। কারণ, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দখলদারত্ব, গাজা–পশ্চিম তীর–জেরুজালেমে বর্বর দমননীতি এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ইসরায়েলকে বহুদিন ধরে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করেছে। তাই এমন একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক কীভাবে সম্ভব—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আমরা বিশ্বাস করি, পূর্বাঞ্চলের সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকাটা ইতিবাচক। আমরাও আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের অংশ হতে চাই। কিন্তু দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের (ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটে) সুস্পষ্ট পথ নিশ্চিত হওয়াও দেখতে চাই।
মোহাম্মদ বিন সালমান, সৌদি আরবের যুবরাজ

এ ছাড়া এ শব্দটি শুনলে মনে হয় যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের আগে কোনো যোগাযোগই ছিল না; যদিও বাস্তবে বহু দেশ গোপনে বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে লেনদেন করত।

ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের আগেই আরব ও মুসলিম–অধ্যুষিত দেশগুলো ফিলিস্তিনের ইহুদি বসতিগুলো বয়কট করেছিল।

১৯৪৮ সালের নাকবার সময় জায়নবাদী মিলিশিয়াদের হাতে প্রায় ১৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হন। এরপর আরব লিগের প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলো (সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও উত্তর ইয়েমেন) ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি।

১৯৫৪ সালে আরব লিগ ‘প্রস্তাব ৮৪৯’ পাস করে আরও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিবেশী নয় এমন দেশগুলোর মধ্যেও ইসরায়েলবিরোধিতা ছড়িয়ে পড়ে। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান এর উদাহরণ। রেজা শাহ পাহলভির আমলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলা ইরানও ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর তা চুকিয়ে ফেলে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুললতিফ বিন রশিদ আল জায়ানি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুললতিফ বিন রশিদ আল জায়ানি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি মিসর–জর্ডানের

১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমলে যুক্তরাষ্ট্র কিছু আইন করে। তাতে দেশটির কোম্পানিগুলোকে আরব বয়কটে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। কার্টারের ভাষায়, ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রক্ষায় এ আইন করা হয়েছে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে ও এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে।

১৯৭৭ সালের নভেম্বরে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জেরুজালেমে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দেশটির পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। এরপর ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি হয় এবং মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।

চুক্তির বিনিময়ে মিসর যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভ করে। এর মধ্যে ছিল আর্থিক সহায়তা ও সিনাই উপদ্বীপ ফেরত পাওয়া। ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে উপদ্বীপটি দখল করেছিল ইসরায়েল। আবার, মিসরও তার অর্থনৈতিক অবরোধ শিথিল করে, সুয়েজ খালসহ নিজের জলভাগ দিয়ে ইসরায়েলের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়।

তবে আরব বিশ্ব এ চুক্তিকে প্রতারণা হিসেবে দেখে। আরব লিগ মিসরের সদস্যপদ স্থগিত করে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। চুক্তির বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত সাদাত খুন হওয়া পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে কায়রোয় সামরিক কুচকাওয়াজে হত্যা করা হয় তাঁকে।

১৯৪৮ সালের নাকবার সময় জায়নবাদী মিলিশিয়াদের হাতে প্রায় ১৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হন। এরপর আরব লিগের প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলো (সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও উত্তর ইয়েমেন) ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি।

এরপর দীর্ঘ বিরতি। ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন–মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তি করে। এর আগে ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তিতে ইসরায়েল ও পিএলও (ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা) পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০০২ সালে আরব লিগ সৌদি আরবের নেতৃত্বে ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ (আরব শান্তি উদ্যোগ) গ্রহণ করে। এর মূল কথা ছিল, ইসরায়েল যদি দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমি ও গোলান মালভূমি পুরোপুরি ছাড়ে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে রাজি হয়, তবে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। কিন্তু ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে।

এ উদ্যোগকে পরবর্তী সময়ে আরব লিগের ২০০৭ ও ২০১৭ সালের সম্মেলনেও সমর্থন জানানো হয় এবং ইয়াসির আরাফাত ও তাঁর উত্তরাধিকারী মাহমুদ আব্বাসের মতো ফিলিস্তিনি নেতারাও এর সমর্থনে ছিলেন। তবে ইসরায়েল এবারও তা প্রত্যাখ্যান করে।

হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারা। ১০ নভেম্বর ২০২৫, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র
হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারা। ১০ নভেম্বর ২০২৫, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্রছবি: এএফপি

আমিরাত–বাহরাইনের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তি

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে প্রথম আব্রাহাম চুক্তিতে সই করেন তাঁরা।

চুক্তিতে ইসরায়েলে এ দেশগুলোর দূতাবাস খোলা, তার সঙ্গে বাণিজ্য শুরু এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়। ‘ইসরায়েলি সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস’–এর তথ্য অনুযায়ী, এর পর থেকে আমিরাত–ইসরায়েল বাণিজ্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। ২০২৪ সালে এটি দাঁড়ায় ৩.২ বিলিয়ন (৩২০ কোটি) ডলার।

আরব আমিরাত ইসরায়েলি অস্ত্র রপ্তানিতে বিনিয়োগ করে। ইসরায়েলি অস্ত্র নির্মাতা এলবিট ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কন্ট্রপ এখন আমিরাত থেকে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে।

নেতানিয়াহু উপসাগরীয় দেশগুলোর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহসের সঙ্গে তেহরানের “অত্যাচারীদের” মোকাবিলা করেছেন। আপনারা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তির জন্য একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করেছেন। আজ আমরা যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করছি, তাতে আপনারা সফলভাবে মধ্যস্থতা করেছেন।’

ফিলিস্তিনিরা এসব চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দেন। তবে আরব বিশ্ব থেকে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। কেউ আরব লিগ থেকে বহিষ্কৃতও হয়নি।

সিরিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক করবে না। আব্রাহাম চুক্তিতে যেসব দেশ সই করেছে, আমি মনে করি, তাদের থেকে সিরিয়ার পরিস্থিতি ভিন্ন।
আহমেদ আল-শারা, সিরিয়ার ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট

ইরানও আব্রাহাম চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসলামি ও আরব বিশ্ব, এ অঞ্চলের দেশগুলো এবং ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা যা করেছে তা অসম্মানের। অবশ্যই, তাদের নীতি কাজ করবে না।’

পরের মাসগুলোতে সুদান ও মরক্কো এ চুক্তিতে যোগ দেয়। তবে সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির প্রতিশ্রুতি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়নি।

মরক্কো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারা নিয়ে দেশটির দাবিকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭০–এর দশক থেকে এটি মরক্কোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চুক্তির পর মরক্কো ইসরায়েলি অস্ত্রশিল্পেও গভীরভাবে যুক্ত হয়েছে।

মরক্কো ও ইসরায়েল আগেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল; বিশেষ করে অসলো চুক্তির পর। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি অভ্যুত্থান) সময় তাদের কূটনৈতিক অফিসগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে সুদানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ‘সন্ত্রাসের মদদদাতা রাষ্ট্রের’ তালিকা থেকে বাদ দেয়; যা তিন দশক ধরে তাদের অর্থনীতির পথে বড় বাধা ছিল।

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার ধাক্কা—থমকে গেছে নতুন চুক্তি

সবাই আশা করছিল, আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি সৌদি আরবই হবে আব্রাহাম চুক্তির পরবর্তী সদস্য। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মনে হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া এ চুক্তিতে সৌদি আরবের যোগদান অত্যাসন্ন।

ওই সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, চুক্তি ‘প্রতিদিন আমরা আরও কাছাকাছি আসছি’ এবং এটি শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ‘সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক চুক্তি’ হতে পারে।

কিন্তু একই বছর অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে সব আলোচনা থেমে যায়। এখন পর্যন্ত সেখানে ৬৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জর্ডান, মরক্কো নিজ দেশেই তীব্র জনবিক্ষোভের মুখে পড়েছে। সৌদি আরব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া এবং নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক করবে না।

এদিকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর আনুষ্ঠানিকভাবে দখল করার জন্য পার্লামেন্ট নেসেটে নতুন আইন পর্যন্ত এনেছে।

ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় সমর্থক কাতার ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করেছে। ২০২৫ সালে কাতারে হামাসের আলোচনাকারীদের ওপর ইসরায়েলি হামলার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

সিরিয়ার ইসলামপন্থী নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাও বলেছেন, সিরিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক করবে না। ১১ নভেম্বর ফক্স নিউজকে তিনি বলেন, ‘আব্রাহাম চুক্তিতে যেসব দেশ সই করেছে, আমি মনে করি, তাদের থেকে সিরিয়ার পরিস্থিতি ভিন্ন।’

ইসরায়েল ১৯৬৭ সাল থেকে গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে সিরিয়ায় স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশটির দক্ষিণে আরও এলাকা দখল করে সেনা মোতায়েন করেছে ইসরায়েল।

‘সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্ত রয়েছে এবং ইসরায়েল গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে। আমরা এখনই সরাসরি আলোচনায় বসতে যাচ্ছি না। হয়তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন আমাদের এ ধরনের আলোচনায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে’, বলেন আল–শারা।

তুরস্ক ১৯৪৯ সাল থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। কিন্তু গাজায় গণহত্যার পর তারা সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়।

পরবর্তী সময়ে আঙ্কারা ইসরায়েলের জন্য তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়, বন্দরে ইসরায়েলি জাহাজ নিষিদ্ধ করে এবং বলে যে তারা বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। তবে কিছু রপ্তানি এখনো চালু থাকার প্রমাণ রয়েছে।

ইসরায়েলের ‘শত্রু দেশ’ লেবাননের ক্ষেত্রেও একই কথা। সেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সমঝোতা’ হিসেবে দেখা হয়; ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ হিসেবে নয়।

লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন গত ১১ জুন বলেছেন, ‘শান্তি মানে যুদ্ধের অবসান—এটাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু (ইসরায়েলের সঙ্গে) স্বাভাবিক সম্পর্ক এখন আমাদের নীতির অংশ নয়।’

ইরাক, ওমান, কুয়েত, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও ইয়েমেনও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ইরান তো বহুদিন ধরেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। গত অক্টোবর মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ‘শিশুদের হত্যাকারী ও গণহত্যায় জড়িত দখলদার রাষ্ট্রকে ইরান কখনো স্বীকৃতি দেবে না।’

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া ইসরায়েলে দেশটির প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য সফর নিয়ে প্রচার হওয়া খবর অস্বীকার করেছে। গাজায় গণহত্যার সময় দেশটিতে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বড় বিক্ষোভ হয়েছে।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশও গণহত্যার কারণে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব প্রবল। তারাও ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো সম্পর্কের বিপক্ষে।

গাজায় গণহত্যা যে ক্ষোভ তৈরি করেছে, তাতে মুসলিম দেশগুলোর কোনো সরকারই এখন ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিতে আগ্রহী নয়। ভবিষ্যতে এটি বদলাবে কি না, নির্ভর করছে বিধ্বস্ত গাজার পরিস্থিতির ওপর।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৭ নভেম্বর ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। ওই পরিকল্পনায় গাজায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানোর কথা রয়েছে; যার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, কাতার, আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশের সেনা থাকতে পারে।

কিন্তু ইসরায়েল এখনো নিয়মিতভাবে গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে চলেছে, লেবাননে হামলা চালাচ্ছে, সিরিয়া দখল করে রেখেছে এবং পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান বাড়িয়ে চলেছে।