রাজনৈতিক সহিংসতা ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন প্রায়ই সাবেক নেতাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি। ইরাকে একই শাস্তি একসময় অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক সহিংসতা একজন প্রেসিডেন্টকে তেমনভাবে থামাতে পারেনি। অন্তত এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এই দুই অবস্থার মাঝে এক অস্বস্তিকর জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
শেখ হাসিনা বছরের শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের ওপর প্রাণঘাতী দমনপীড়নের ঘটনায় আদালতে নিজের অনুপস্থিতিতেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ওই ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রতিবাদ, বাড়তি টিউশন ফি, দুর্নীতি ও পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে। দ্রুতই সেই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশজুড়ে বড় বড় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত হন, হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করা হয় এবং ক্ষোভ দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হঠাৎই বন্ধ করে দেয়া হয়। সহিংসতা বাড়তে থাকলে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারত গিয়ে নিঃশব্দে আত্মপ্রকাশ করেন।
‘চোখের বদলে চোখ’ নীতির বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শেখ হাসিনার শাস্তি তার অপরাধের অনুরূপ মনে হতে পারে। কিন্তু পেছনে আরও অনেক কিছু চলছে। তার শাস্তি এমন একটি জানালা খুলে দেয় যেখান দিয়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে ঠিক করে কে শাস্তি পাবে, কে টিকে থাকবে, আর কেন ভিন্ন ভিন্ন দেশে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার একই ধরনের চেষ্টা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিণতি বয়ে আনে। সব রাজনৈতিক নেতা সমান মাত্রার সহিংসতা ব্যবহার করেন না, কিন্তু তাদের সবার মধ্যেই একই প্রবৃত্তি দেখা যায়। তাহলো ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের শেষ সীমায় ঠেলে দেন। যদিও এর মাত্রায় বড় পার্থক্য আছে হাসিনার প্রাণঘাতী দমন, ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী হস্তক্ষেপের মধ্যে। তবুও একটি অভিন্ন তাগিদ স্পষ্ট হয়: রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে গণতান্ত্রিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই পার্থক্য নেতাদের উদ্দেশের মধ্যে নিহিত নেই, বরং তা আছে তাদের কাজকে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থার শক্তি ও তার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, ব্রাজিল জায়ের বোলসোনারোকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে নিষিদ্ধ করেছে, ইরাক সাদ্দামকে বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক ফৌজদারি মামলার পরও ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে টিকে আছেন।
কেন ট্রাম্প টিকে গেলেন আর হাসিনা টিকলেন না
বাংলাদেশে সহিংস দমনপীড়ন একটি রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটিয়েছে এবং আইনি প্রতিশোধ ডেকে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ৬ জানুয়ারির সরাসরি হামলার পরও ডনাল্ড ট্রাম্পের আবার নির্বাচনে জেতার পথে বাধা হয়নি। ট্রাম্পের রাজনৈতিক টিকে থাকার বিষয়টি নির্ধারিত হয়েছিল সেদিনের বাস্তব ঘটনা দিয়ে নয়, বরং মার্কিন প্রতিষ্ঠানের শক্তি এবং আমেরিকান সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ দিয়ে। আদালত ট্রাম্পের দলের ডজনখানেক মামলা বাতিল করে দেয়, কংগ্রেস ফলাফল নিশ্চিত করে এবং ফেডারেল সংস্থাগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যায়। তবুও এসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ট্রাম্পের রাজনৈতিক উত্থানকে ঠেকাতে পারেনি। গভীর দলীয় মেরুকরণ- গণতান্ত্রিক আদর্শের বদলে দলীয় পরিচয়ে- জবাবদিহির মানে ঠিক করে দেয়। এর ফল হয় এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। তা হলো এমন একটি ব্যবস্থা যা রাজনৈতিক সহিংসতা শোষণ করতে পারে, কিন্তু সেই সহিংসতা উস্কে দেয়া নেতাকে শাস্তি দিতে পারে না।
এই তুলনাগুলো থেকে একটি সহজ কিন্তু প্রায়ই ভুলে যাওয়া সত্য প্রকাশ পায়। তাহলো নেতার কার্যকলাপের চেয়ে তার রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধরনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোথাও সহিংসতা দমন নেতাকে অযোগ্য ঘোষণা করে, কোথাও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ধাক্কাটা সামলে নেয়। এই টানাপোড়েনই হাসিনার ঘটনাকে বিস্ফোরক করেছে। আওয়ামী লীগ মনে রায়ের সমালোচনা করে। বিরোধীরা মনে করে এটাই বিলম্বিত বিচার।
দুর্বল প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিকে অস্থিতিশীলতায় রূপ দেয়
সাদ্দাম হোসেন পরবর্তী ইরাক একটি সতর্কবার্তা। দুটি অবস্থার মধ্যে কাঠামোগত মিল আছে। তাহলো দশকের পর দশক স্বৈরশাসন, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, গভীর সামাজিক বিভাজন, প্রতিবেশীদের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব এবং উত্থানশীল ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু ইরাক দেখিয়েছে- যখন প্রতিষ্ঠান দুর্বল, তখন কঠোর শাস্তি স্থিতিশীলতা আনে না, বরং পরিস্থিতি খারাপ করে। সাদ্দামকে শাস্তি দেয়ায় শান্তি আসেনি; বরং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়েছে, রাষ্ট্রের অবশিষ্ট কাঠামো ভেঙে দিয়েছে এবং বছরের পর বছর অস্থিরতার আগুন জ্বালিয়েছে।
বাংলাদেশ এখন তার নিজের পরীক্ষার মুখে: বিচার করা যাবে কি সমাজ ছিন্নভিন্ন না করে?
ইতিহাস বলে শুধু শাস্তি কোনো দেশকে স্থিতিশীল করতে পারে না। বৈধতা- আইনি রায়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আর বাংলাদেশ এই পথে আগেও হেঁটেছে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে গণপ্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল। সেই আন্দোলনও তীব্র সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়িয়েছিল। তথাকথিত ‘আংশিক বিচার’ও সামাজিক ভাঙন তৈরি করেছিল- এটাই ছিল ভবিষ্যতের সতর্ক সংকেত।
বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা
এই রায়টি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের জন্যও একটি পরীক্ষা। আদালত, আমলা, নিরাপত্তা বাহিনী- সবাই পর্যবেক্ষণে রয়েছে। যদি এরা কোনো একটি পক্ষের সঙ্গে একাত্ম মনে হয়, জনবিশ্বাস নষ্ট হয়। নেতারা ক্ষমতা ছাড়তে ভয় পায়। বিরোধীরা নির্বাচনে আস্থা হারায়। নাগরিকদের মধ্যে নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে বিশ্বাসে চির ধরতে পারে। বিশ্বাস ভেঙে গেলে দেশ প্রতিশোধের চক্রে ঢুকে পড়ে- স্থিরতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়।
এ ধরনের মুহূর্তগুলো দেখায় যে, যে ব্যবস্থায় ক্ষমতা দীর্ঘদিন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল, সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব কতটা ভঙ্গুর হতে পারে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত জনতার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে দিতে পারে। একবার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা অনেক কঠিন।
আঞ্চলিক রাজনীতি এই ঝুঁকি আরও বাড়ায়। হাসিনা বর্তমানে ভারতে আছেন, আর বাংলাদেশ তাকে প্রত্যর্পণ চাইছে। দিল্লির প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিপথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।
কেন বিশ্বকে গুরুত্ব দিতে হবে
বাংলাদেশ, ইরাক ও যুক্তরাষ্ট্রের একই ধরণ দেখায় যে, রাজনৈতিক সহিংসতার ফল নেতার কাজের ওপর নয়, প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে সহিংসতা দমন একটি ক্যারিয়ার শেষ করেছে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারে। ইরাকে একনায়ককে শাস্তি দেয়া দেশকে বছরের পর বছর অস্থিতিশীল করে। যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক সহিংসতার ধাক্কা শোষণ করেছে এবং একজন প্রেসিডেন্টকে টিকে থাকতে দিয়েছে।
‘একই কাজ, ভিন্ন ফল।’ এটিই বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা এবং যে কেউ রাজনৈতিক জবাবদিহি কীভাবে কাজ করে তা বোঝার চেষ্টা করছে তার জন্যও। এটি নৈতিক সমতার প্রশ্ন নয়। এটি কাঠামোর প্রশ্ন- কে টিকে থাকবে, কে পড়ে যাবে- তা ঠিক করে প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম।
যদি বিচার পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়, তা মেরুকরণ বাড়ায়। আর সমাজে বিশ্বাস ভঙ্গুর হলে বৈধতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা হয়ে দাঁড়ায়।
জবাবদিহির সীমা
হাসিনার রায় পুরোনো এক দ্বন্দ্বকে সামনে আনে: বিচার বাস্তব হতে হবে। কিন্তু ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যও হতে হবে। যখন জবাবদিহি প্রতিশোধের মতো মনে হয়, তখন তা নিরাময় করে না- উল্টো বিভক্ত করে। দক্ষিণ আফ্রিকার পোস্ট-আপার্টহাইড মডেল বিচারকে পুনর্মিলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল-
জবাবদিহিকে বৈধতার সঙ্গে মিশিয়েছে। বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ বিপরীত চ্যালেঞ্জের সামনে: দমনমূলক কর্মকাণ্ড, দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও মেরুকৃত সমাজ। প্রতিশোধ সম্ভব। অস্থিরতা সম্ভাব্য।
এ ধরনের পরিবর্তন সরলরেখায় চলে না। যে সমাজে ব্যাপক ঐক্যমত নেই, সেখানে বিচার হয়ে ওঠে প্রতিযোগিতার আরেকটি ক্ষেত্র- সমাপ্তির বদলে নতুন আগুন জ্বালায়। একই রায় প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করলে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার বার্তা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
গ্লোবাল সাউথ-এর বাস্তবতায়, ভারতের মতো শক্তিধর প্রতিবেশীর ভূমিকা নির্ধারক হতে পারে। মেরুকরণ গভীর হলে বাংলাদেশ ইরাকপরবর্তী পরিস্থিতির মতো এক চক্রে ঢুকে যেতে পারে- বিচারের ভিন্ন ব্যাখ্যা, বৈধতার প্রতিযোগী দাবি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বড় হতে পারে। তখন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা প্রক্রিয়াগত নয়, অস্তিত্বগত হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ইরাক নয়, কিন্তু সতর্কবার্তা বাস্তব: বিভক্ত জনমত, পক্ষপাতদুষ্ট প্রক্রিয়া এবং ভীত নেতারা দীর্ঘ অস্থিতিশীলতার মঞ্চ তৈরি করতে পারেন।
সারকথা
হাসিনার রায় শুধু একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরীক্ষা- পুরোনো ক্ষত সারিয়ে নতুন ক্ষত তৈরি না করে এগোতে পারবে কি না। সামনে যা হবে, তা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে। ইতিহাস কড়া সতর্কতা দেয়। ইরাকে সাদ্দাম পতনের পর কঠোর শাস্তি স্থিতিশীলতা আনেনি, বরং বিশৃঙ্খলা বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এমন ধাক্কাও সামলেছে, যা অন্য দেশে সরকার উল্টে দিতে পারত। বাংলাদেশ এখন নিজেই এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। বিচার কি দেশকে এক করবে, নাকি আরও দূরে ঠেলে দেবে?
ঝুঁকি অনেক বড়। এটি কোনো একজন নেতার ভাগ্যের প্রশ্ন নয়, এটি একটি তরুণ গণতন্ত্র কি অতীতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ ভেঙে না ফেলে
এগোতে পারবে কি না তার প্রশ্ন। মূল সত্যটাই রয়ে যায়: রাজনৈতিক টিকে থাকা কখনোই ব্যক্তির ওপর নয়, ব্যবস্থার শক্তির ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ এই শিক্ষা এখন বাস্তবে পাচ্ছে- আর সেদিকে বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
(লেখক ওয়েইনে স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ক্যান্ডিডেট। অনলাইন এফপিআইএফ থেকে তার এ লেখাটির অনুবাদ)