Image description
 

রাজশাহীর ছয়টি আসন ঘিরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ঘিরে বিএনপির ভেতরের বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে। মনোনয়ন-বিক্ষোভে বাড়ছে চাপও। একসময় দলের দুর্গ বলে পরিচিত এই অঞ্চলে এবার নিজ দলীয় কোন্দলই বিএনপির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। বিপরীতে জামায়াত আগেভাগেই প্রার্থী চূড়ান্ত করে তৃণমূলে প্রচার চালাচ্ছে। নতুন শক্তি এনসিপিও লড়াইয়ে নামছে। রাজশাহীর রাজনৈতিক মাঠে বিএনপির ভেতরের অস্থিরতা সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের।

রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) : এ আসনটি বরাবরই ছিল বিএনপির দখলে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সালে সব কটি নির্বাচনেই এ আসনে বিএনপির ব্যারিস্টার আমিনুল হক নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও জামায়াত। ফলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকার প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি হন।

২০২৬-এর নির্বাচনে আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৬ জন। এবার আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। দল থেকে মনোনীত হয়েছেন ব্যারিস্টার আমিনুলের ভাই ও বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন। তবে তাকে বাদ দেওয়ার দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই আন্দোলন করছেন মনোনয়নবঞ্চিতরা। এ আসনে জামায়াত থেকে লড়বেন দলটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। ফলে রাজশাহীর এ আসনটি হেভিওয়েট হিসেবে দেখা হচ্ছে।

রাজশাহী-২ (সদর) : ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে কবীর হোসেন এবং ২০০১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এমপি নির্বাচিত হন। মিজানুর রহমান মিনু ১৯৯১ সাল থেকে টানা ১৭ বছর রাজশাহী সিটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। মেয়র থাকাকালেই ২০০১ সালের নির্বাচনে সারাদেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা আর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে মূলত ১৯৯৬ সাল থেকেই রাজশাহী মহানগর বিএনপির রাজনীতি মিনুর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টি ফজলে হোসেন বাদশা ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এমপি ছিলেন। তবে সবশেষ ২০২৪ সালের আওয়ামী নির্বাচনে দলটির ডামি প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা এমপি হন।

এ আসনে এবার লড়ছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। অভ্যন্তরীণ নানা কারণে দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পরই রাজশাহী-২ (সদর) আসনে পাল্টে গেছে বিএনপির রাজনীতির দৃশ্যপট।

মিজানুর রহমান মিনু দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। রাজশাহী মহানগর বিএনপির রাজনীতি দীর্ঘ সময় মিনুর নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও তার ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্বে ভেদাভেদ ভুলে নেতাকর্মীরা অল্প সময়েই হয়ে উঠেছেন চাঙ্গা।

আসনটি জামায়াতের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে রাজশাহী মহানগরীর নায়েবে আমির ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে। এরই মধ্যে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে সমাবেশ করেছে। নারীদের নিয়েও তারা আলাদা সভা করেছে। গঠন করা হয়েছে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য নির্বাচনী কমিটিও।

নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) এ আসনে নামছে লড়াইয়ে। এরই মধ্যে দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও নির্বাচনী বোর্ডে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এনসিপির রাজশাহী মহানগর শাখার আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলী লাল্টু।

রাজশাহী-৩ ( মোহনপুর-পবা) : ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সরদার আমজাদ হোসেন নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে এ আসনের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। ৬৭ হাজার ৮৬৩ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপি থেকে আবু হেনা। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন। ২০০১ সালে ও আবু হেনা নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আসনটি পুনর্বিন্যাস করা হয়। এতে বড় দলগুলোও প্রার্থী পরিবর্তন করে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেরাজ উদ্দিন মোল্লাহ নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির কবির হোসেন।

বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সহ-সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। মিলন রাজশাহী মহাগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সারাজীবন মহানগরেই রাজনীতি করেছেন। কিন্তু বাইরের আসন থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষুব্ধ দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাধিক অংশ। বিশেষ করে সাবেক যুবদল নেতা রায়হানুল আলম রায়হান ও প্রয়াত কবির হোসেনের ছেলে নাসির হোসেন এ আসন থেকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তাদের অনুসারী নেতাকর্মীরা মিলনকে বাদ দেওয়ার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। তবে এ আসনেও মিলন বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই তিনি পবা-মোহনপুর নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন।

এখানে জামায়াতের প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। তিনি পবা হড়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান।

রাজশাহী-৪ (বাগমারা) : ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির সরদার আমজাদ হোসেন বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসনটি চলে আসে বিএনপির দখলে। ওই নির্বাচনে বিএনপির আবু হেনা আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেনকে পরাজিত করেন। ২০০১ সালের ভোটেও এমপি হন বিএনপির আবু হেনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক নির্বাচিত হন।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৫১ জন। এ আসনে এবার বিএনপির নতুন মুখ হিসেবে লড়বেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়া। বাগমারা বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা বলছেন, মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই জিয়ার অনুসারীরা নানা অপকর্মে জড়িয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এরই মধ্যে জিয়ার আপন ভাই ডিএম শাফি এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রফিক মেম্বারসহ বেশ কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। এ ছাড়া ওসি এবং আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হুমকি দেওয়ায় জিয়া ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে জিডি।

এদিকে এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামাল হোসেন এবং রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল। টুটুলের অভিযোগ, জিয়া দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তার অনুসারী নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএম জিয়া বলেন, ‘যারা প্রার্থী হন, তারা কোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটান না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে আমি এবং আমার অনুসারীরা ভোটের মাঠে রয়েছি।’

তবে জিয়ার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠে আছেন জামায়াতের প্রার্থী ডা. আব্দুল বারী। তিনি প্রতিদিনই এলাকায় নানা কর্মসূচি পালন করছেন। বিএনপির কোন্দলের কারণে নির্বাচনে মাঠে দলের প্রার্থী জিয়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।

রাজশাহী-৫ (দুর্গাপুর-পুঠিয়া) : ১৯৯১ সালে এ আসনে ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৬১ হাজার ২১৮ জন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তাজুল ইসলাম ফারুক ৪৭ হাজার ১৯৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাত্তার মণ্ডল পান ৩৫ হাজার ৪৮২ ভোট। তবে ১৯৯৬ সালে আসনটি পায় বিএনপি। নাদিম মোস্তফা পরাজিত করেন আওয়ামী লীগের তাজুল ইসলাম ফারুককে। ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন ধানের শীষের প্রার্থী নাদিম মোস্তফা। তবে ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আবদুল ওয়াদুদ দারা।

রাজশাহী-৫ আসনে এবার ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৫১ জন। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল। তবে তার দলীয় মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন নেতাকর্মী। তারা নজরুলকে ‘জনবিচ্ছিন্ন’ উল্লেখ করে তৃণমূলের জনপ্রিয়, ত্যাগী এবং পরীক্ষিত কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে বঞ্চিত দলীয় পাঁচ প্রার্থীর অনুসারীরা একাট্টা হয়েছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও মহাসড়ক অবরোধসহ লাগাতার কর্মসূচি। নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের দুঃসহ শাসনামলে অধ্যাপক নজরুল কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আসেননি। নিজেকে নিরাপদ রাখতে সব সময় দলের নেতাকর্মীদের এড়িয়ে চলেছেন।

অপরদিকে আগেভাগেই প্রার্থিতা ঘোষণা করে মাঠে আছে জামায়াত। এ আসনে এবার তাদের প্রার্থী জেলা সহকারী সেক্রেটারি নূরুজ্জামান লিটন। আসনটি এবার দখলে নিতে মরিয়া জামায়াত। এরই মধ্যে দুটি উপজেলাতেই নির্বাচনী কমিটি গঠন করেছে।

রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) : ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৭০ হাজার ২৩৬ জন। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আজিজুর রহমান ৪৮ হাজার ৫৪২ ভোট পেয়ে এমপি হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ডা. আলাউদ্দিন পান ৪৬ হাজার ১৪৬ ভোট। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ডা. আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বিএনপির প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটি ফিরে পায় বিএনপি। ওই বছর বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে কবির হোসেন ৮৮ হাজার ২৭৩ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসন আবারও দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শাহরিয়ার আলম ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৩ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন।

এবার এ আসনে ভোটারসংখ্যা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ১৮০ জন। নির্বাচনে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আছেন বিএনপির প্রার্থী আবু সাইদ চাঁদ। দুটি উপজেলাতেই তার বিপুল জনপ্রিয়তা। তিনি সব সময়ই নেতাকর্মীদের পাশে থাকেন। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক চাঁদ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে ছিলেন নির্যাতিত। সারাদেশে তার নামে মামলা হয়েছিল। চাঁদ এলাকায় তৃণমূলের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত।

চাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে মাঠে আছেন দাঁড়িপাল্লার প্রার্থী নাজমুল হক। তিনি জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি। সাংগঠনিকভাবে নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি মাঠে আছেন।