রাজনৈতিক দলগুলোতে নির্বাচনী ব্যস্ততা বেড়েছে। গণভোট, সংস্কার, আইনশৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছাপিয়ে জোরেশোরে চলছে ভোটের প্রস্তুতি। জামায়াত গত বছর ৫ আগস্টের পরপরই কার্যক্রম শুরু করায় নির্বাচনী আয়োজনের প্রায় সব কাজই গুছিয়ে এনেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা গণসংযোগ শুরু করলেও এখনও প্রার্থী বাছাই শেষ হয়নি। পোলিং এজেন্ট নির্ধারণ ও প্রশিক্ষণ কাজ শুরু করতে পারেনি। অন্যদিকে এনসিপির ব্যস্ত সময় যাচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণে
সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি দেরিতে শুরু করলেও এখন তাতে গতি আনার চেষ্টা করছে বিএনপি। প্রার্থী বাছাই শেষ না হলেও প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। গণসংযোগ, পোলিং এজেন্ট বাছাই, প্রশিক্ষণ, এলাকাভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করছেন তারা। কেন্দ্রীয়ভাবেও চলছে জোর প্রস্তুতি। তবে দলীয় প্রার্থীদের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা এখনও দেওয়া হয়নি।
সংসদ নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হতে পারে বলে মনে করছে বিএনপি। এ জন্য সামাজিক মাধ্যম ও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ সুসংহত করতে এরই মধ্যে সাতটি টিম গঠন করেছে দলটি। যদিও নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। তপশিল ঘোষণার পর এ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত রয়েছে।
বিএনপির জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ প্রার্থী বাছাই। গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে অর্ধশতাধিক আসনে শুরু হয় ‘মনোনয়ন বিদ্রোহ’। বাকি যে ৬৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা হয়নি, সেখানেও চলছে নানা যোগ-বিয়োগ।
বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, তারেক রহমান দেশে আসার পর সবকিছুতে গতি আসবে। এর আগে মাঠ জরিপের মাধ্যমে পাওয়া বিভিন্ন প্রার্থীর অসংগতি দূর করার চেষ্টা চালানো হবে। সেখানে আসনভিত্তিক জটিলতা, প্রার্থীর দুর্বলতা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সক্ষমতা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, ১৬ বছর এ দেশের জনগণ ভোট দিতে পারেনি। নতুন প্রজন্ম তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে উৎসবমুখর ভোট আয়োজনে বিএনপি সব প্রস্তুতি নিয়েছে। এর মধ্যে ২৩৭ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। ধাপে ধাপে অন্যান্য প্রক্রিয়াও সামনে আনা হবে।
শতাধিক আসনে প্রস্তুতিতে ঘাটতি
২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে অর্ধশতাধিক আসনে নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সংঘাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এতে বেকায়দায় পড়েছেন দলীয় প্রার্থীরা। বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে কঠোর বার্তা দেওয়ার পরও দমানো যাচ্ছে না অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ফলে ৫০টির বেশি আসনে নির্বিঘ্নে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি দলটি। আর ৬৩ আসনে প্রার্থী না দেওয়ায় সেসব এলাকায় নির্বাচনী প্রস্তুতির সূচনাই হয়নি। সেগুলোর বেশির ভাগ আসনে সমমনা ও মিত্র দলের জন্য ছাড় দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনা আছে। জোটের বিষয়েও ধোঁয়াশা থাকায় সংশ্লিষ্ট নেতারা নির্বাচনের প্রস্তুতি থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। সব মিলিয়ে শতাধিক আসনে এখনও বিএনপি অপ্রস্তুত।
সাত কমিটি গঠন
মূলধারার গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ সুসংহত করতে সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিএনপি। এ কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সাতটি দলের প্রতিটিতে সদস্য সংখ্যা সাত। প্রতি দলের একজন টিমপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন।
আসনভিত্তিক প্রস্তুতি
যেসব আসনে দলীয় বিরোধ তেমন নেই, সেখানে প্রার্থীরা গণসংযোগের পাশাপাশি নির্বাচনের সব আয়োজন এগিয়ে নিচ্ছেন। পোলিং এজেন্ট বাছাই, তাদের প্রশিক্ষণ, বিকল্প এজেন্ট প্রস্তুত করার কাজ করছেন। অনেকে নিজ এলাকার সুবিধা-অসুবিধা আর জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করছেন। প্রার্থীর ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড টানানো হচ্ছে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে। সেখানে দেশ গঠনে বিএনপির কর্মপরিকল্পনা, রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফাসহ নানা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হচ্ছে।
এ ছাড়া উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করছেন বিএনপির প্রার্থীরা। সেখানে এলাকার উন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেবেন, সেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটার কাছে টানতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। মাদকের ভয়াবহতা থেকে দূরে রাখতে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চলছে। নারীর জন্য দল ঘোষিত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছেন বিএনপি নেতারা।
ঢাকা-১৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী আমিনুল হক সমকালকে বলেন, নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি। আওয়ামী লীগ আমলে এলাকার উন্নয়ন হয়নি, তাদের নেতাকর্মীদের পকেটের উন্নতি হয়েছে। এখন আমরা উন্নয়নবঞ্চিত জনগণের মতামত নিচ্ছি। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এলে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করব।
প্রতিপক্ষের দিকে নজর
প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কার্যক্রমের দিকেও নজর রাখছেন বিএনপির প্রার্থীরা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণার কৌশল, ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতার বিপরীতে নিজস্ব কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।
এর মধ্যে মসজিদ-মাদ্রাসা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে যাতে জামায়াত প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা করতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছেন বলেও অনেক প্রার্থী জানিয়েছেন। জামায়াতের নারী কর্মীর প্রচারণার দিকেও খেয়াল রাখছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ধর্মীয় তালিমের নামে যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি না ছড়াতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে বলে বিএনপির অনেক প্রার্থী জানিয়েছেন।
ভোলার চরফ্যাশন আসনে বিএনপির প্রার্থী নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, রাজনীতি হবে সামনাসামনি। গুপ্তভাবে কোনো রাজনীতি হয় না। আবার ধর্মকে ব্যবহার করেও প্রকৃত রাজনীতি হয় না। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে মসজিদকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে, তাদের জনগণই রুখে দেবে।
সামাজিক মাধ্যমে তৎপরতা বাড়ানোর উদ্যোগ পিছিয়ে পড়া সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে দলটির তৃণমূলের শক্তিকে সুসংগঠিত করে অনলাইন প্রচারণাকে আরও জোরদার এবং কথিত ‘বট বাহিনী’র অপপ্রচার মোকাবিলায় গঠন করা হচ্ছে নতুন প্ল্যাটফর্ম।
১৫ সদস্যের এই প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্ব দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার। তাদের একেকজন ২০ আসনে কো-অর্ডিনেশন করবেন। এই প্ল্যাটফর্মের অধীনে প্রত্যেক নির্বাচনী আসনে দুজন করে অনলাইন এক্টিভিস্ট থাকবেন। এই উদ্যোগ শুধু তৃণমূলে দলের সাংগঠনিক শক্তিকেই মজবুত করবে না, একই সঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও কথিত ‘বট বাহিনী’কে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার কৌশল নিয়েছে দলটি। বিএনপির এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য– নির্বাচনী প্রচারণার আগে থেকেই দলের বার্তা দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া। মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম বিস্তার করতে দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে দুজন করে ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে।