Image description

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে টেকসই উত্তরণ এবং চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করে এ বিষয়ে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ এবং বন্দরের বিষয়সহ কোনো দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেবলমাত্র নির্বাচিত সরকারের। এ বিষয়ে এমন কোনো সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যাদের নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই। দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে এমন সিদ্ধান্তে সময় চাওয়াটাই একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কেন ভান ধরছি যে, আমাদের কোনো বিকল্প নেই? কেন আমরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ সীমাবদ্ধ করছি? স্থগিতের বিকল্প প্রকাশ্যে বন্ধ করে দিয়ে আমরা নিজেরাই আলোচনা করার ক্ষমতা দুর্বল করছি। আন্তর্জাতিক আলোচনায় আমরা প্রভাব খাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করে আগেই দুর্বল অবস্থান থেকে টেবিলে বসছি।

সোমবার রাতে ওই পোস্টে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, ‘ধরুন গাজীপুরের একটি ছোট পোশাক কারখানার মালিকের কথা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। শতাধিক শ্রমিককে কর্মসংস্থান দিয়েছেন। অতি সামান্য মুনাফা করে কারখানা চালিয়ে গেছেন। নির্মম বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করেছেন। হঠাৎ একদিন, যে শুল্ক সুবিধায় তার পণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলক থাকতো কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সেটা নীরবে হারিয়ে গেল। এর ফলে তার অর্ডার কমতে থাকে। এতে কারখানা চালু রাখা, শ্রমিকদের মজুরি ও নিজের পরিবার সামলানো নিয়ে তিনি চাপে পড়েন।

আরেকটি উদাহরণ দিয়ে তিনি লেখেন, এবার কল্পনা করুন নারায়ণগঞ্জের সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা এক তরুণীর কথা। তিনি তার পরিবারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যেতে দেখছেন। তার বাবা একটি কারখানায় কাজ করেন। সংসারের সব খরচ মেটাতে ওভারটাইমই তার ভারসা। রপ্তানির ওপর চাপ পড়লেই প্রথমে ওভারটাইম বন্ধ হয়। এরপর শিফট কমে। তারপর চাকরি চলে যায়। এগুলো সাধারণ পরিবারের নীরব সংকট। এই সিদ্ধান্ত নিতে তারা কোনো ভোট করেনি। কেউ তাদের জিজ্ঞাসাও করেনি। বাস্তব সংখ্যাগুলোও তাদের দেখানো হয়নি। এই কারণেই বাংলাদেশের এলডিসি উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে যে বিতর্ক তা সরকারি বিবৃতির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে।

 

তারেক রহমানের ফেসবুক পোস্টের স্ত্রিনশর্ট

তারেক রহমানের ফেসবুক পোস্টের স্ত্রিনশর্ট

 

এলডিসি উত্তরণ প্রসঙ্গ
তারেক রহমান লিখেছেন, বিএনপি আগে থেকেই বলে আসছে, ২০২৬ সালে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় ঠিক রেখে স্থগিতের বিকল্প খোলা না রাখার মতো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার কোনো নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই। তারপরও এই সরকার এমন দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে দশকের পর দশক প্রভাবিত করবে। আমাদের বলা হলো, সময় বাড়ানো ‘অসম্ভব’। এমনকি স্থগিতের অনুরোধ করাটা নাকি ‘অপমানে’র এবং জাতিসংঘ নাকি সেটা বিবেচনাও করবে না। কিন্তু একটু গভীরে তাকালে দেখা যায়, ইতিহাস ভিন্ন ও আরও জটিল কথা বলে।

তিনি লিখেছেন, অ্যাঙ্গোলা ও সামোয়ার মতো দেশ তাদের উত্তীর্ণ হওয়ার সময় সংশোধন করেছে। জাতিসংঘের নিয়মই বলে, কোনো দেশ অর্থনৈতিক ধাক্কায় পড়লে এই সময় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে এমন সিদ্ধান্তে সময় চাওয়াটাই একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কেন ভান ধরছি যে, আমাদের কোনো বিকল্প নেই? কেন আমরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ সীমাবদ্ধ করছি? স্থগিতের বিকল্প প্রকাশ্যে বন্ধ করে দিয়ে আমরা নিজেরাই আলোচনা করার ক্ষমতা দুর্বল করছি। আন্তর্জাতিক আলোচনায় আমরা প্রভাব খাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করে আগেই দুর্বল অবস্থান থেকে টেবিলে বসছি।

সরকারের নথিতেই স্বীকার করা হয়েছে যে, ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই ব্যাংকখাতে চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ঋণঝুঁকি বৃদ্ধি ও রপ্তানি মন্থর হয়ে যাওয়ার প্রভাব অনুভব করছেন। এটা এলডিসি উত্তরণে বিরোধিতা নয়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার অধিকার অর্জন করেছে। কিন্তু ‘অধিকার’ থাকা আর ‘প্রস্তুত’ থাকা এক বিষয় নয়। আমার মনে হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো সন্দেহ না থাকা মানেই সেটা প্রকৃত জাতীয় শক্তি নয়। প্রকৃত জাতীয় শক্তি হলো, অপরিবর্তনীয় কিছু হয়ে ওঠার আগেই কঠিন প্রশ্নগুলো করার সুযোগ থাকা।

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রসঙ্গ
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। সেখানে যা হয় তার প্রভাব লাখো মানুষের জীবনে অনেক গভীর প্রভাব ফেলে। বন্দরকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তগুলো কোনোভাবেই রুটিন কাজ নয়। এগুলো জাতীয় সম্পদ নিয়ে কৌশলগত অঙ্গীকার- যা একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বেঁধে দেওয়ার মতো করে এগিয়ে নিচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে যা দেখা যাচ্ছে, তা এলডিসি উত্তীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়ারই প্রতিচ্ছবি। কৌশলগত বিকল্পগুলো বন্ধ। জনআলোচনাকে ঝামেলা মনে করা হচ্ছে। যুক্তিসঙ্গত উদ্বেগকে ‘অনিবার্যতা’র কথা বলে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলি- এটা কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ নয়। এটি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা এবং এই নীতিকে রক্ষা করা যে, দেশের ভবিষ্যৎকে দশকের পর দশক প্রভাবিত করতে পারে এমন সিদ্ধান্ত নেবে সেই সরকার যার জনগণের কাছে জবাবদিহি রয়েছে।

তারেক রহমান লিখেছেন, কেউ বলছে না যে, আমাদের এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া উচিত নয় বা বন্দর সংস্কার করা উচিত নয়। যুক্তিটা খুবই সহজ ও মৌলিক- একটি দেশের ভবিষ্যৎ এমন সরকারের হাতে বন্দি থাকা উচিত নয়, যাকে এই জাতি নির্বাচিত করেনি। কৌশলগত ধৈর্যধারণ কোনো দুর্বলতা নয়। জনপরামর্শ কোনো বাধা নয়। গণতান্ত্রিক বৈধতা কোনো বিলম্ব নয়। আর আমার মতে, এটাই হয়তো এসবের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য। বাংলাদেশের মানুষ কখনও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তারা সম্মান, মতপ্রকাশের অধিকার ও পছন্দের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে- এ কারণে তারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে ও ত্যাগ করেছে। তাদের দাবি খুবই সাধারণ—তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, তাদের সম্মান দিতে হবে। এ জন্যই আমাদের অনেকেই তাকিয়ে আছি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের দিকে। কারণ, এটাই বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার, নির্বাচিত করার এবং এই সহজ সত্য পুনর্ব্যক্ত করার সুযোগ যে, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ এই বিশ্বাসকে ধারণ করে এ দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে এ দেশেরই মানুষ।