বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন তারেক রহমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্তমান সময়ে কোনো জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্বকে বুলিং করা, তাকে নিয়ে মিথ্যা মিম তৈরি করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু তারেক রহমানের ক্ষেত্রে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সেটা শুরু করেছিল অনেক আগেই, ২০০১ সাল থেকে। জনপরিসরে অনেকের ধারণা তারেক রহমান রাজনীতিতে এসেছেন ২০০০ সালের পরে। এই মিথ এখনও মানুষের মধ্যে আছে; এমনকি তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের করা ভ্রান্ত অভিযোগগুলো এখনও কিছু কিছু মানুষের মধ্যে গ্রথিত।
আসল সত্যটা কি? তারেক রহমান বগুড়ার গাবতলী উপজেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন ১৯৮৮ সালে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির নির্বাচনি প্রচারণার কৌশলী কমিটির সদস্য হিসেবে সারাদেশে নিরলস কার্যক্রম চালান। দীর্ঘ ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে সব বিশ্লেষককে হতবাক করে দিয়ে বিএনপি জয়ী হয়। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তারেক রহমান সেই সময়টাতে দলীয় কোনো পদ পদবীতে নিজেকে জড়াননি। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে দল থেকে উনাকে প্রার্থী করার জন্য বলা হয়। কিন্তু তিনি সানন্দে তা প্রত্যাখান করেন। তখন তিনি দলের কোনো পদও গ্রহণ করেননি।
২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারেক রহমানকে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য জ্যেষ্ঠ্য যুগ্ম মহাসচিব পদে পদায়ন করা হয়। দায়িত্ব পেয়ে প্রথমেই তারেক রহমান সবচেয়ে ইউনিক যে কাজটা শুরু করেন তা হচ্ছে ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ২০ থেকে ৩০ মাইল একাধারে হাঁটতেন। প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যেতেন, মানুষের সাথে হাত মেলাতেন। তারেক রহমান সেই পদাঙ্কটাই অনুসরণ করলেন। তারেক রহমান যে ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন শুরু করেছিলেন ঠাকুরগাঁও থেকে তা বাংলাদেশে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ব্যাপক সফলতা পাওয়া এবং জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক কর্মসূচি আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে হতচকিত করে তোলে। ঠিক সেই সময়েই তারা তারেক রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতাতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অপতথ্য ছড়িয়ে তারেক রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপিকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করে। তারেক রহমান তার রাজনৈতিক কর্মশালাগুলোতে প্রায় ১৮টি বিষয়ের উপর একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে দিতেন। প্রশ্নে থাকত— আপনি কেন বিএনপি কে সমর্থন করেন? ২১ শতকের রাজনীতিতে কি ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত? ইত্যাদি। একেকটা গণসংযোগে প্রায় কয়েক হাজার কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকত। মানুষ খুব আগ্রহভরে তার কথা শুনত। তৃণমূলের এই সম্মেলন যুগান্তকারী ছিল। তিনি প্রায় ১৮ হাজার পত্রযোগাযোগ করেছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই তিনি একজন অসাধারণ ধৈর্য্যশীল এবং কর্মপিপাসু মানুষ ছিলেন—যার প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে আজকের বিএনপিতে। একটি সুসংগঠিত এবং সর্ববৃহৎ দলে পরিণত হয়েছে বর্তমান বিএনপি; তারেক রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে।
এক এগারোর মূল ষড়যন্ত্রটাই ছিল বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেওয়া। এ এক গভীর ষড়যন্ত্র ছিল বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নেতৃত্ব থেকে দূরে সরিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সমূলে উৎপাটন করার অপপ্রয়াস। তারেক রহমানকে অমানসিক নির্যাতন করা হয়! ২০০৭ সালের ২৮ নভেম্বরে আদালতের কাঠগড়ায় তিনি তার উপর অমানবিক নিপীড়নের বিবরণ তুলে ধরেন—
‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে বেঁধে রেখে ( ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা) আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ, কোনো সন্ত্রাসী নই। এর আগে আমার চিকিৎসার জন্য আদালত নির্দেশ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার রিমান্ডে নিলে আমি আর বাঁচব না। আমি রিমান্ডে শারীরিকভাবে এতটাই নির্যাতনের শিকার হয়েছি যে, এখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না। চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আমাকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা মোটা কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে আমাকে।’
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথকে অবরুদ্ধ করার জন্য ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। একটি জবরদস্তিমূলক শাসনব্যাবস্থা কায়েম করেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে ফেলে। বিএনপি সহ অপরাপর সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপির অগণিত নেতা কর্মীর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় আওয়ামী লীগ এবং তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা প্রদান করে জেলে নিয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নিপীড়ক এবং ফ্যাসিস্ট, নির্মমতাই যার শিল্প সেই জগদ্বিখ্যাত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির স্বিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলের হাল ধরেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন।
বিএনপিকে ভাঙার জন্য শেখ হাসিনার সরকার এমন কোনো চেষ্টা নাই যা করেনি। দলের বিভিন্ন নেতাকে প্রলোভন দেখানো, ভয় দেখানো, ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে অথবা পুলিশের মাধ্যমে দিন নেই, রাত নেই যে কোনো সময় ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার, কিংস পার্টি গঠন ইত্যাদি নানান রকম চেষ্টা। কিন্তু শেখ হাসিনার সব কূটচাল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তারেক রহমানের যুগোপযোগী নেতৃত্বে।
তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন লেভেলের কর্মীদের সঙ্গে নিজেই যোগাযোগ করতেন। আন্দোলন সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত নেতা ও কর্মীদের সব ধরনের আইনি সহায়তার ব্যাবস্থা করতেন। দেশের প্রয়োজনে যেকোন আন্দোলনে তিনি নেতা কর্মীদের উজ্জীবিত করতেন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি নিজে যেমন সক্রিয় ছিলেন, ঠিক তেমনি বিএনপির প্রতিটি অঙ্গসংগঠনকেও সক্রিয় রেখেছিলেন।
তারেক রহমানের সবচেয়ে বড় সফলতা বোধ করি, এত দূর থেকে নেতৃত্ব দিয়েও বিএনপির মত সর্ববৃহৎ দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। এটা উনার একটা অসাধারণ ক্যারিশমা। আওয়ামী লীগের সমস্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করে বিএনপির প্রতিটি নেতা, কর্মী ইস্পাত কঠিন ঐক্য ধরে রাখে তারেক রহমানের প্রতি আস্থাশীল থেকে। বিভিন্ন সময় পত্রিকার কলামে, টক শোগুলোতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলতেন বিএনপি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজনৈতিক সংগ্রামে এবং কর্মসূচিগুলোতে তারেক রহমান নতুনত্ব নিয়ে আসেন। পদযাত্রা, ইউনিয়ন পর্যায়ে গণসংযোগ, জেলা ও বিভাগীয় সমাবেশ, অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, রাজনৈতিক পরিসরে তারেক রহমানকে, বিএনপিকে অনিবার্য করে তোলে।
২০২৩ সালের ১৩ জুলাই তিনি এক যুগান্তকারী প্রয়াস নেন, রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা জাতির সামনে হাজির করেন। মূলত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ কে ভিত্তি ধরে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তাকে আমলে নিয়ে তিনি এই ৩১ দফা প্রস্তাবনা দেন। আজকের বাংলাদেশে যেই সংস্কার কমিশনগুলো কাজ করছে তারেক রহমান ২০২৩ সালেই এই সংস্কার কমিশনগুলোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন যার স্পষ্ট উল্লেখ আছে ১৫ নম্বর দফায়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথাও প্রথম বলেছিল বিএনপি। আজকের বাংলাদেশের সংস্কার ভাবনাগুলো তারেক রহমান চিন্তা করেছেন অনেক আগেই যার অকাট্য প্রমাণ ৩১ দফা। ৩১ দফার রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা মূলত বাস্তবভিত্তিক, টেকসই সংস্কারের অনন্য দলিল।
৫ ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে তারেক রহমান এবং বিএনপির অবিস্মরণীয় ভূমিকা বাংলাদেশ স্মরণ রাখবে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। দেশ নিয়ে নিরন্তর ভাবনায় মগ্ন তারেক রহমানের মননে একটাই ভাবনা, ‘আমার আগে আমরা, আমাদের আগে দেশ। ক্ষমতার আগে জনতা, সবার আগে বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গণমানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল তারেক রহমান। তারেক রহমানের ষাটতম জন্মবার্ষিকীতে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ।
