Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খুলনায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সরব হয়ে উঠেছে। জেলার ছয়টি আসনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দলের নেতারা আগেভাগেই মাঠে নেমেছেন। তাঁদের কেউ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গণসংযোগ করছেন, কেউ আবার দলীয় নেতা–কর্মীদের নিয়ে সভা–সমাবেশ করে সংগঠিত করছেন। সব মিলিয়ে খুলনার রাজনৈতিক অঙ্গন এখন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সরগরম।

ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। খুলনা-১ আসনটি আপাতত ‘ফাঁকা’ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন সব আসনেই প্রার্থী নির্ধারণ করে আগেভাগেই গণসংযোগ শুরু করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বললেও, এখনো মাঠে দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থীরাও একটি করে আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ফলে খুলনাজুড়ে একধরনের নির্বাচনী আমেজ তৈরি হয়েছে।

খুলনা–১ আসন

১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের দখলে ছিল খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনটি। ২০০১ ও ২০০৮ সালে অবশ্য বিএনপি প্রার্থী তুলনামূলক ভালো ভোট পেয়েছিলেন। একসময় বাম দলের প্রভাব থাকলেও জামায়াতের অবস্থান সব সময় দুর্বল ছিল। ১৯৯৬ সালে শেষবার জামায়াত প্রার্থী দিয়েছিল এবং মাত্র দুই হাজার ভোট পেয়েছিল।

খুলনায় বিভক্তির রাজনীতির চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এখনো আছে, আমরা সেটা মোকাবিলা করব।
নজরুল ইসলাম, বিএনপি মনোনীত প্রার্থী (খুলনা-২)

সম্প্রতি এই আসনে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা বেড়েছে। এবার বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতের আমির শেখ আবু ইউসুফ আবারও প্রার্থী হয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা আবু সাঈদও মাঠে আছেন।

এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছেন সাবেক জেলা আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান, যিনি ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। পাশাপাশি এলাকায় গণসংযোগ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান (পাপুল) ও সাবেক ছাত্রনেতা পার্থ দেব মণ্ডল। বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে দাকোপ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কিশোর কুমার রায়ও জোরেশোরে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

খুলনা–২ আসন

১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে খুলনা-২ (সিটি করপোরেশন ১৬-৩১ নম্বর ওয়ার্ড) আসনে জামায়াত আর প্রার্থী দেয়নি। এবার জামায়াত প্রার্থী করেছে কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও নগর জামায়াতের সেক্রেটারি শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলালকে। তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আমান উল্লাহও প্রচারণায় আছেন। গণসংহতি আন্দোলনের খুলনা জেলা আহ্বায়ক মুনীর চৌধুরী সোহেলও এখানে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন।

এখন সবাই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আছি; তফসিল ঘোষণার পর পরিবেশ বোঝা যাবে।
শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন, সেক্রেটারি, নগর জামায়াত (খুলনা-২)

আসনটিতে নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি ২০০৮ সালে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন এবং ২০১৮ সালেও বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ২০২১ সালে দলীয় নেতৃত্ব হারানোর পর কিছুটা কোণঠাসা হলেও রাজনীতি থেকে সরে যাননি। এবার মনোনয়ন পাওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা উচ্ছ্বসিত। তবে নগর বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব রয়ে গেছে, যা দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে মনে করছেন দলীয় নেতা–কর্মীরা।

এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনায় বিভক্তির রাজনীতির চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এখনো আছে, আমরা সেটা মোকাবিলা করব। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। খুলনার সাংগঠনিক বিষয়গুলো নিয়ে সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছেন। মনোনয়নকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে বলে মনে করি। এখন প্রার্থীকেন্দ্রিক রাজনীতিকেই সাজাতে হবে।’

তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর হুসাইন। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের পরিচয়পর্ব, সালাম–শুভেচ্ছা বিনিময় চলছে। আমরা মাঠে তৎপর আছি, দোয়া চাচ্ছি। দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিতে ভোটারদের উৎসাহিত করছি। এখন সবাই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আছি; তফসিল ঘোষণার পর পরিবেশ বোঝা যাবে।’

সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন বলেন, ‘আমরা নিজেদের মতো করে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। খুলনা শহরে প্রতিদিন দিনমজুর ভাড়া করে প্রচারণা চালাচ্ছেন অন্য দলের প্রার্থীরা। আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছি।’

খুলনা–৩ আসন

সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড, যোগীপোল ও আড়ংঘাটা ইউনিয়ন নিয়ে খুলনা–৩ আসন। শ্রমিক–অধ্যুষিত এ এলাকায় অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালা করে জিতেছে। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল এবারও প্রার্থী হচ্ছেন। এ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নেই বললেই চলে।

এ আসনেও জামায়াত ১৯৯৬ সালের পর কখনো প্রার্থী দেয়নি। এবার জামায়াতের প্রার্থী নগর জামায়াতের আমির মাহফুজুর রহমান গণসংযোগ করছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল প্রচার চালাচ্ছেন। এর আগে কেসিসি নির্বাচনে তিনি ৬০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন।

খুলনা–৪ আসন

রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া নিয়ে খুলনা-৪ আসন। আসনটি অতীতে কখনো বিএনপি, কখনো আওয়ামী লীগের দখলে গেছে। ২০১৮ সালের মতো এবারও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। 

এখানে জামায়াতের প্রার্থী খুলনা জেলা কমিটির নায়েবে আমির কবিরুল ইসলাম। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী দলের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ। তাঁরা দুজনই এলাকায় মোটামুটি সক্রিয়।

ইসলামী আন্দোলনের খুলনা মহানগরের সহসভাপতি শেখ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এক বাক্স’ নীতিতে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। খুলনা–৩ ও ৪ আসনে কেন্দ্রীয় দুই নেতা প্রার্থী। জোট হলেও এ দুটি আসনের বিষয়ে তাঁদের জোর দাবি থাকবে।

খুলনা–৫ আসন

ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা–৫ আসন। অতীতে আসনটি আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে পালাবদল হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন ছাড়া এখানে বিএনপি কখনো জেতেনি। এবার মর্যাদার আসন হয়ে উঠেছে এটি। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার নিয়মিত গণসংযোগ করছেন।

দীর্ঘ ২৯ বছর পর বিএনপি এ আসনে নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছে আলী আসগর লবিকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে খুলনা–২ আসন থেকে খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আলী আসগর। এই ব্যবসায়ী ২০০৯ সাল থেকে রাজনীতির মাঠে ছিলেন না। তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় কয়েক মাস ধরে তিনি নির্বাচনী গণসংযোগ করছেন। এখানে বিএনপির দৃশ্যমান কোনো কোন্দল নেই।

এ আসনের লক্ষাধিক ভোটার হিন্দু সম্প্রদায়ের। দুই প্রার্থীই তাঁদের ভোট টানতে মরিয়া। জামায়াত হিন্দু কমিটি গঠন করেছে। গত মাসে উপজেলা স্বাধীনতা চত্বরে হিন্দু কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনে বক্তব্য দেন গোলাম পরওয়ার। বিএনপির প্রার্থীও নিয়মিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আবদুস সালাম এখানে তেমন সক্রিয় নন।

খুলনা-৬ আসন

স্বাধীনতার পর থেকে বিএনপি কখনোই খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে জয় পায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের অংশ হিসেবে আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবার এখানে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন সদ্য দায়িত্ব পাওয়া জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী। তাঁর বাড়ি রূপসা উপজেলায়। তাঁর এই ‘বহিরাগত’ পরিচয় স্থানীয় রাজনীতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

মনিরুল হাসান মনে করেন, দীর্ঘকাল পর এখানে নিজস্ব প্রার্থী পেয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা উৎফুল্ল।  সবাই প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। দলের সবাইকে নিয়ে কাজ করবেন তিনি।

জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন তৎপরতা চালাচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও খুলনা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এর আগেও তিনি ওই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের জেলা সেক্রেটারি আসাদুল্লাহ আল গালিব এ আসনে দলের ঘোষিত প্রার্থী।

দৃশ্যমান নয় এনসিপি ও জাতীয় পার্টি

খুলনায় জাতীয় পার্টি ও এনসিপির নির্বাচনী কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান নয়। জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী মাহমুদুল হাসান ফয়জুল্লাহ বলেন, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক ওয়াহিদুজ্জামান খুলনা–১ এবং কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব ফরিদুল হক খুলনা–২ আসনে প্রার্থী হতে পারেন। তাঁরা নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়নে কমিটি দেওয়ার কাজ চলছে।