ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তাবিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিকর্মকে ‘একতরফা’ এবং ‘অবৈধ’ দাবি করে তা বন্ধে জাতিসংঘের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ২০১৮ সালে নিশি-রাতের ভোটে এমপি হওয়া জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আবদুল মোমেন। যিনি ’২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমাগত উদ্বেগকে উপেক্ষো করে গুম, খুনসহ বর্বর নির্যাতন চালিয়ে বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমন করে টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। ওই কর্তৃত্ববাদী শাসনে ড্রাইভিং সিটে ছিলেন ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতের আশ্রয় নেয়া দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বরাবর পাঠানো চিঠিতে ড. মোমেন লিখেন, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচন বৈধ বা গণতান্ত্রিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা বৃটেনের মতো কোনো গণতান্ত্রিক দেশ গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর এমন আঘাত কখনোই মেনে নেবে না। দেশগুলোর আদালত, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকরা তাৎক্ষণিকভাবে এমন ‘প্রহসন’ প্রত্যাখ্যান করবে।
চিঠিটি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নয় বরং নিজের ক্যাপাসিটিতে দিয়েছেন বলে মানবজমিনের কাছে দাবি করে ড. মোমেন। সেইসঙ্গে তিনি এর একটি কপি শেয়ার করেন। চিঠিতে জাতিসংঘ সনদ, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. মোমেন বলেন- প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থি। উল্লিখিত উদ্বেগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় পরিচালিত ব্যালট প্রজেক্ট এমন নির্বাচনী প্রক্রিয়া সমর্থন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যা বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলসহ আরও কয়েকটি প্রধান দলকে বাদ দিচ্ছে। এই দলগুলো দেশের প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটের প্রতিনিধিত্ব করে দাবি করে তিনি বলেন- এমন পরিস্থিতি কেবল জাতিসংঘের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই ক্ষুণ্ন করবে না বরং ইউএনডিপি’র অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ম্যান্ডেটেরও পরিপন্থি বলে বিবেচ্য হবে। এহেন নির্বাচনকে উৎসাহিত করা জাতিসংঘের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দুর্বল করবে। চিঠিতে মোমেন লেখেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন এমন এক নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে যেখানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হচ্ছে না। যদিও তারা দীর্ঘদিন ধরে জনসমর্থন ও শাসনকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অত্যাসন্ন নির্বাচন প্রস্তুতিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হতে পারে- এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে মোমেন বলেন, সেই নির্বাচনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১২ দিন। সেই নির্বাচনে গঠিত সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। সেইসঙ্গে তখন দেশে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যার অধীনে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়েছিল।
মোমেন প্রশ্ন রেখে বলেন- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কী ঘটতে চলেছে? চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, অংশগ্রহণহীন নির্বাচনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব নয় বরং তা রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও গভীর করবে। জনগণের আস্থা দুর্বল করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়াবে। গণতন্ত্রকে বর্জন বা চাপিয়ে দেয়া যায় না এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন- এটি অবশ্যই জনগণের অংশগ্রহণ ও মালিকানার ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। এই বিপজ্জনক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের মন্ত্রী জাতিসংঘের প্রতি স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানান। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি সুপারিশ রাখেন। সেগুলো হলো- ১. কোনো নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নির্বাচনে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ২. একটি নিরপেক্ষ, সময়সীমাবদ্ধ অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা। ৩. এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত হবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসংঘ ও বিশেষ করে মহাসচিবের অফিস যেন অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী রূপরেখা প্রণয়ন বিষয়ে জোর দেন সেই আহ্বান রাখেন ড. মোমেন। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করে বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক উত্তরণের আহ্বান জানান তিনি। চিঠিতে মোমেন লিখেন, আমি বিশ্বাস করি, এসব পদক্ষেপ জাতিসংঘের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও সংকট প্রতিরোধের দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ধরনের পদক্ষেপের অভাব বা বিলম্ব জাতিসংঘের গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দাবি করে তিনি চিঠির সমাপনীতে বলেন- এই মুহূর্তে নীরবতা বা বিলম্বকে একপক্ষীয় ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মতি হিসেবে দেখা হবে। দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা রোধে এবং জাতিসংঘ যে মূল্যবোধ অন্যদের কাছে দাবি করে তা নিজেই রক্ষায় মহাসচিবের নেতৃত্ব অত্যাবশ্যক।