ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর জোটবদ্ধ নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান চূড়ান্ত করায় জোটবদ্ধ নির্বাচনের বিষয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও ইসলামী দলগুলোর ভোট এক বাক্সে আনার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আসন সমঝোতা হতে পারে। গতকাল জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান সিলেটে বলেছেন, জামায়াত কোনো নির্বাচনী জোট করছে না।
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে যুগপথ আন্দোলন করছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সমমনা ৮ দল। আসন্ন নির্বাচনে এসব দল জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে- এমনটাই ভাবা হচ্ছিল এতদিন। দলগুলোর নেতারাও এমন আভাস দিচ্ছিলেন। তবে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এ ছাড়া জামায়াত-এনসিপি’র সাম্প্রতিক টানাপড়েন, জোট হলেও দলীয় প্রতীকে ভোট করতে হবে- নির্বাচন কমিশনের এমন নীতিমালার প্রভাবও পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাঁচ দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে থাকা জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনের একাধিক নেতা জানান, ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর জোটবদ্ধ নির্বাচনের চেষ্টা চলছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে বৃহস্পতিবার এই ৮ দলের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে। একই দাবিতে ১১ই নভেম্বর রাজধানীতে ৮ দলের মহাসমাবেশ হওয়ার কর্মসূচিও আছে।
গতকাল সিলেটে সাংগঠনিক সফরকালে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আগামী নির্বাচনে জামায়াত কোনো জোট গঠন করবে না, তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে। আর এই সমঝোতার স্বার্থে জামায়াত ঘোষিত সংসদ সদস্য প্রার্থী তালিকায়ও অনেক পরিবর্তন আসতে পারে।
প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (পীর চরমোনই)। বুধবার মানবজমিনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর জোটবদ্ধ নির্বাচনের চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলে আশাকরি জোটের ব্যাপারে সমমনারা আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তবে ইসলামী আন্দোলনের অন্য একটি সূত্র মতে, জোটবদ্ধ নির্বাচন না হলেও আসন সমঝোতার নির্বাচন হবে।
সূত্র মতে, আসন্ন নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর ভোট একবাক্সে নেয়ার আওয়াজ ওঠে ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে। এজন্য উদ্যোগী ভূমিকায় নামেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম (পীর চরমোনাই)। তাকে সমর্থন জোগান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। এই দুই নেতার সম্মিলিত উদ্যোগ অনেকটা সফলও হয়েছে। এ পর্যন্ত আটটি দল একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করছে।
গত জুলাই মাসে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামীর মহাসমাবেশে দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির দাবি ওঠে। দুই দলের ব্যানারে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও ইসলামী এবং সমমনা অন্তত ১০টি দলের শীর্ষ নেতারা এতে বক্তব্য রাখেন। এ সময় ওইসব দলের বক্তারা আগামী নির্বাচনে সব ইসলামী এবং সমমনা দলের ভোট এক বাক্সে দেয়ার অঙ্গীকার করেন।
তবে, বিভক্ত বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এই উদ্যোগের বাইরে আছে। এসব অনিবন্ধিত দল বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়ার জন্য আগ থেকেই তৈরি হয়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিএনপি’র সঙ্গে জোটে যাওয়ার চেষ্টায় থাকা এসব ইসলামী দলের নিবন্ধন নেই। উপরন্তু প্রায় সকলেই নাম সর্বস্ব কিংবা প্যাড সর্বস্ব একাধিক অংশে বিভক্ত। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকাও উল্লেখ করার মতো নয়। তারপরও একটি বৃহৎ রাজনৈতিক জোটে যেতে পারলে ওই জোটের পরিধি বাড়বে বৈ কমবে না এমনটাই মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে ইতিপূর্বে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রকিব বলেছেন, আমরা অতীতেও বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটে ছিলাম এখনো আছি। বর্তমানে আমরাই ইসলামী ঐক্যজোটের মূলধারায় আছি। ওদিকে নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা একে এম আশরাফুল হক বলেন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মূলধারা আমাদের সঙ্গে আছে। নাম এবং প্যাড সর্বস্ব যে দল আছে তাদের সঙ্গে নেজামে ইসলাম পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, মঞ্চ ময়দানে আমাদের রাজনৈতিক তৎপরতাই দৃশ্যমান। আর কারও কোনো তৎপরতা নেই দাবি করেন তিনি।
এদিকে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি জোটের প্রার্থী হতে পারেন ইসলামী দলগুলোর ১২ নেতা। এসব নেতাকে আসন ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে বলে জানা যায়। আসনগুলো হচ্ছে- সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর এবং কোম্পানীগঞ্জ) আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট মোহম্মদ আলী, সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসেন কাসেমী, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে নেজামে ইসলাম পার্টির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, কুমিল্লা-২, (হোমনা-তিতাস) আসনে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, মুন্সীগঞ্জ-১ (সিরাজদিখান-শ্রীনগর) আসনে মাওলানা আবদুল হামিদ (পীর মধুপুর), চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি-ভুজপুর) আসনে নেজামে ইসলাম পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা শেখ মোহাম্মদ শাহজাহান, ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর-আদাবর) আসনে খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক, শরীয়তপুর-১ (পালং-জাজিরা) আসনে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ, ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা-মধুখালী) আসনে খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুফতি শরাফত হোসাইন, এবং চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী- বায়েজিদ বোস্তামী) আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা নাসির উদ্দীন মুনির। এদের মধ্যে মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা জালালুদ্দীনসহ একাধিক নেতা আন্দোলনরত ৮ দলের প্রথম সারিতে আছেন।