Image description

‘কাকের বাসায় কোকিলের ছা- যার ছা তার রা’। প্রকৃতির সত্য-নির্ভর এই প্রবচনের অর্থ হলো: কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, ডিম ফোটে, কাকের স্নেহে পালিত হয়, একদিন উড়ে চলে যায়; কিন্তু স্বর ও স্বভাব (রা) কখনোই বদলায় না। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে সাড়ে পনেরো বছর যাবৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আন্ডারগ্রাউন্ডে সক্রিয় ছিল।


ছাত্রলীগের ভেতরে থেকে এমনকি ‘ছাত্রলীগ নেতা’ পদ-পরিচয় বহন করেও তৎপর ছিলেন ছাত্রশিবির নেতারা। জুলাই গণÑঅভ্যুত্থান পরবর্তী ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্যে আবির্ভাব নিয়ে নানান প্রশ্ন ও বিতর্ক ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাস ছাপিয়ে রাজনীতি সচেতন নাগরিক মহলে আলোচনা-সমালোচনার যেন শেষ নেই। এখানে-সেখানে রাজনীতি সচেতন মানুষের কথাবার্তায় উঠে আসছে ঘুরেফিরে, ছাত্রশিবির-টু-ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ-টু ফের ছাত্রশিবির। এ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত এক বছর আগে।


তবে ডাকসু নির্বাচনের পরই বিতর্ক ও আলোচনা আবারো তাজা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগরসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড শিবির এবং ‘ছাত্রলীগ’ ব্যানারে থাকা শিবিরের তৎপরতার বিষয়টি ক্রমেই চাউড় হয়। তবে হাসিনা আমলে ছাত্রলীগের পদ-পদবি কিংবা পরিচয়ে আগস্ট’২৪ইং পরবর্তী প্রকাশ্যে আসা ছাত্রশিবিরের কোনো কোনো নেতার নাম থাকলেও, ছাত্রশিবির নেতারা ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।


ডাকসু নির্বচন শেষ হলেও তার রেশ প্রবলভাবে চলছে। ডাকসু-জাকসুতে ছাত্রশিবির ভূমিধস জয় পেয়েছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল পরাজিত হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কও অব্যাহত আছে। ডাকসু নির্বাচন কী আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে? কেউ বলছেন প্রভাব পড়বে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। এরইমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু-জাকসু নির্বাচন। সামনে আছে রাকসু-চাকসুর ভোট।


এ অবস্থায় অনেকেরই মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্যাম্পাসের সংসদ নির্বাচনগুলো বেশ জোরালো ফ্যাক্টর হবে। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনায় চলছে তোলপাড়। সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোগুলোতে তুমুল বিতর্ক থেকেও তা সহজে বোঝা যায়। জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে রাজনীতির মাঠে এখন ডাকসু নির্বাচন অন্যতম বিষয়।


এ প্রসঙ্গে অভিমত জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ও একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সমাজ চিন্তাবিদ ড. মইনুল ইসলাম আজ সোমবার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলবে। জামায়াত সরকার গঠন করতে না পারলেও; আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চাইতে বেশি সংখ্যক আসন তারা পাবে এবং প্রধান বিরোধীদল থাকবে। কেননা তারা শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুই দখলে নিয়েছে এবং প্রভাব বিস্তার করছে। ছাত্রশিবির ডাকসু-জাকসু শুধু নয়; বাকি সবগুলো ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ দখল করবে।


প্রসঙ্গ ‘কোকিলের ছা...’
‘এবার শিবিরের ঢাবি শাখার সেক্রেটারির পরিচয় জানা গেল, পদ ছিল ছাত্রলীগেও’ শিরোনামে গত ২৩ সেপ্টেম্বর’২৪ইং প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ‘সভাপতির পরিচয় প্রকাশের পর তুমুল আলোচনার মধ্যে সামনে এল ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারির পরিচয়। এস এম ফরহাদ (সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৭-১৮) নামে এই শিক্ষার্থী থাকতেন কবি জসীমউদ্দীন হলে। তিনি ছাত্রলীগেরও পদধারী ছিলেন। খোঁজ নিয়ে এস এম ফরহাদের ছাত্রশিবিরের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।


এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর’২৪ইং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগ দেওয়ার পর ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি সাদিক কায়েমের পরিচয় সামনে আসে। শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সেক্রেটারি এস এম ফরহাদের পরিচয় সামনে এলে তার পরিচিতজনদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ এস এম কামরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী চার বছর ধরে ফরহাদের সঙ্গে একই হলে একই কক্ষে (৩০৮ নম্বর) থাকতেন। ফরহাদের শিবির শুনে বিস্মিত কামরুল ফেসবুকে লিখেন, ‘মানুষ অবাক হয়। মাঝেমধ্যে প্রচÐ অবাক হয়। কেউ কেউ অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়ে’!


তাছাড়া পাওয়া গেছে ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকত ও রাকিব সিরাজীর সঙ্গে এস এম ফরহাদের তোলা ছবি। ২০২২ সালের নভেম্বরে ঘোষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে রয়েছে এস এম ফরহাদের নাম। ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকার আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স (গোপন রাজনীতি) করতে বাধ্য করেছে। আমাদের দানব আকারে হাজির করা হয়েছে’।


‘ছাত্রলীগের পদ নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি’ শিরোনামে গত ২৩ সেপ্টেম্বর’২৪ইং প্রথম আলোয় প্রকাশিত অপর এক সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ এক বিবৃতিতে দাবি করেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি ও কার্যক্রমের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের ২০২২ সালের নভেম্বরে ঘোষিত কমিটিতে এস এম ফরহাদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের কোনো পদ-পদবির জন্য কোনো সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) আমি কখনো কাউকে দিইনি’।


ছাত্রদল মানে অভিযোগের ফেরিওয়ালা?
‘অভিযোগ করা মানে নিজের পরাজয় স্বীকার করা’ -জর্জ বার্নার্ড শ। ‘অভিযোগ হচ্ছে অলস মস্তিষ্কের কাজ’ -সক্রেটিস। ‘অভিযোগের পেছনে লুকানো থাকে নিজের ব্যর্থতা’ -স্টিভ জবস


পণ্ডিতদের কথা, দুর্বল লোকের অভিযোগ বেশি। ডাকসু, জাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রশিবির ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। হতেই পারে অভিযোগগুলো যৌক্তিক। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের আগে বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল নিজেদের কতদূর গুছিয়ে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থী তথা ভোটারদের সামনে হাজির হতে পেরেছে। কতটা পরিকল্পিত ছিল প্রচারণা-শিক্ষার্থী সংযোগ? সামনে রাকসু, চাকসু নির্বাচনের জন্যই-বা ছাত্রদল কতটা প্রস্তুত?


ছাত্রশিবির কেন জয়ী? ছাত্রদল কেন হারলো? এ বিষয়ে ছাত্রদলের ১০১টা অভিযোগ কিংবা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু ভোটের পালা শেষ। শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের যুক্তি ও অভিযোগ শোনার সময়ও ফুরিয়ে গেছে। ১০১টা অভিযোগের কারণ যাতে না ঘটে এরজন্য ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ভোটের প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল কিনা? সময়ের কাজ সময়ে না করে ছাত্রদল কী এখন অভিযোগের ফেরিওয়ালা হবে? ভাবসঙ্গীতে বলা হয়, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। ‘সময় এবং নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করেনা’।


পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রলীগের সাথে মিশে ছাত্রশিবির সাড়ে পনেরো বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিল, যা অভিনব। অন্যদিকে ওই সাড়ে ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আমলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার এবং অধিকাংশ কর্মী ক্যাম্পাস ছাড়া হতে বাধ্য হয়।


অথচ ৫ আগস্ট’২৪ইং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরেরও বেশি ‘সুসময়ে’ ছাত্রদল সুবর্ণ সুযোগগুলোকে কী সদ্ব্যবহার করেছে? নাকি দেশের প্রায় সর্বত্র ছাত্রদল (যুবদলও) নামটির সঙ্গে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বাজার-ঘাট-হাট দখল, থানা পুলিশের দালালি এমনকি অনেকেরই বিরুদ্ধে মাদকাসক্তিতে জড়িত হয়ে দলের ইমেজের সর্বনাশ ঘটানোর কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? এর ফলে ছাত্রদলই শুধু নয়; সুযোগ পেয়ে ক্রমাগত প্রতিপক্ষের প্রপাগান্ডায় ছাত্রদলের নামে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা পারসেপশন তৈরি হয়েছে। যতটা নয় তার চেয়ে বেশি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা হয়েছে ‘ছাত্রদল মানে ভিলেন’ এ ধরনের পারসেপশন বা দৃষ্টিভঙ্গি।


অন্যদিকে ছাত্রশিবির হলের শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যা, ভর্তি পরীক্ষায় ও কোচিংয়ে সহায়তা ইত্যাদি শিক্ষার্থী-বান্ধব কর্মকাণ্ডর আড়ালে শিক্ষার্থীদের সমর্থন আকর্ষণের চেষ্টায় মরিয়া। ছাত্রলীগ পরিচেয় শিবিরের গোপন রাজনীতির বিষয়টি সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ছাত্রদল যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি। এরফলে এ ক্ষেত্রে শিবিরের নেগেটিভ পারসেপশনও বলতে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত।


বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হাসিনা ফ্যাসিস্ট শাসনামলে একটি কথা প্রায়ই বলতেন, বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদল জাতীয়তাবাদী শক্তি ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে ওঠা দল। তারা সময়মতো ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে। অন্যদিকে বিএনপিসহ বৃহত্তম দলটির অঙ্গ সংগঠনের বেশিরভাগ নেতা-নেত্রী সামনের নির্বাচনে এমপির টিকিট নিশ্চিত করতে মরীয়া। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ধানের শীষের কাক্সিক্ষত টিকিটি লাভ মানে নিশ্চিত এমপি। আবার প্রথমসারির নেতারা অনেকেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুনজরে পড়ার নানামুখী চেষ্টা-তদবির এবং মন্ত্রিত্ব লাভের স্বপ্নে বিভোর।


জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির অভ্যুত্থান পরবর্তী সুবর্ণ সুযোগ দলীয় স্বার্থে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রশাসনের স্তরে স্তরে নিজেদের লোকজন বসিয়ে দেয়ার মাধ্যমে প্রভাব বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা আজকাল প্রায়ই যান না নিজ এলাকায়। তৃণমূলে একশ্রেণির নেতা-কর্মীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি চলছেই। অথচ কেন্দ্রীয়, নগর ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারা নির্বিকার। অনেকেই অঘোষিত লাইসেন্স দিয়েছেন। ভাগ বাটোয়ারা করছেন। এলাকাবাসী বিশেষত ব্যবসায়ীরা ত্যক্ত-বিরক্ত।


এ অবস্থায় মির্জা ফখরুলের সেই ফিনিক্স পাখির জেগে ওঠা হবে কবে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বারবার বলে আসছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন যত সহজ ভাবছেন অত সহজ হবে না। বরং অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কে শোনে কার কথা। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই- আমার সোনার হরিণ চাই’।