
কাতারের রাজধানী দোহায় আরব ও মুসলিম বিশ্বের নেতারা এক শীর্ষ সম্মেলনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানোর ব্যাপারে একমত হয়েছেন। কেউ কেউ আরব বিশ্বের নিরাপত্তা রক্ষায় ন্যাটোর আদলে ‘সম্মিলিত নিরাপত্তা বাহিনী’ গঠনের আহ্বানও জানিয়েছেন। রোববার ও সোমবার আরব লীগ এবং ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য দেশগুলো ‘আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে’ মিলিত হয়। এতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণে একটি প্রস্তাব পাস হয়। তাতে বলা হয়, ইসরায়েলের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
গত ৯ সেপ্টেম্বর হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে কাতারে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে কাতারসহ মুসলিম বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল থানি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক সভায় জোরালে বক্তব্য তুলে ধরেন।
সম্মেলনে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বলেন, ইসরায়েলের আগ্রাসন স্পষ্ট। তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্বাসঘাতকামূলক ও কাপুরুষোচিত। তারা গাজা যুদ্ধের অবসানের জন্য আলোচনাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
ওইআইসির মহাসচিব হিসেন ব্রাহিম তাহা বলেন, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার এখনই সময়। আরব লীগের মহাসচিব আহমেদ আবুল ঘেইত ইসরায়েলকে একটি ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি আরব ও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সম্প্রদায়ের জন্য ন্যাটোর আদলে প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান এই অঞ্চলের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আহ্বান জানান।
আরব ও ইসলামী দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: ইরান
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, মুসলিম নেতাদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার করা উচিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কেবল একটি স্পষ্ট বিকল্প আছে, তা হলো ঐক্যবদ্ধভাবে হাতে হাত রেখে দাঁড়ানো। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, সব মুসলিম ভাই ভাই। তাই আমাদের একটি দেহের মতো থাকা উচিত।’
ইরানি নেতা বলেন, ‘গত জুন মাসে ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল কেবল তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেনি, বরং আমাদের জনগণের মর্যাদাও লঙ্ঘন করেছে। আমাদের এই হুমকির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত। মুখ বুজে আর অন্যায় সহ্য করার সময় নেই। গাজায়, বৈরুত বা ইয়েমেনে যা ঘটেছে, তাতে চুপ থাকা উচিত নয়’। তিনি বলেন, ‘শুধু ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্য নয়, মানবতার ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।’
এর আগে রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার ফিলিস্তিন সংকট মোকাবেলায় স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আরব দেশগুলো তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় সম্মিলিত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এই বাহিনীতে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তানও দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছুক।
রয়টার্স জানায়, আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনের দিত খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কাতারের ওপর ইসরায়েলি হামলা ন্যাক্কারজনক ঘটনা। দখলদার দেশটির কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজা-হামাস প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষে অনড় যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েল সফরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদের আলোচনায় মিত্র দেশগুলোর জোট শক্ত করার বিষয়ে কথা হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারে হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করতে ইসরায়েল সফরে আসেন রুবিও। সোমবার নেতানিয়াহুর পশ্চিম জেরুজালেম অফিসে তাদের মধ্যে দুই ঘণ্টার বৈঠক হয়। পরে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলি নেতা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল এক অপরকে রক্ষা করাতে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে। ইসরায়েল যেখানেই থাকুক না কেন, হামাসকে আঘাত করা হবে। হামাস প্রশ্নে রুবিও নেতানিয়াহুর সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ সশস্ত্র উপাদান হিসেবে হামাসের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা উচিত।
গাজায় বর্বর হামলা চলছেই, নিহত ২৫
রোববার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৬ জন শুধুমাত্র গাজা সিটিতেই নিহত হয়েছে। গাজায় ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনির মতে, গত চার দিনে গাজায় জাতিসংঘের ১০টি ভবনে হামলা হয়েছে। সোমবার নিহতদের মধ্যে ৬ বছর বয়সী যমজ শিশুও রয়েছে। গত ২৩ মাসে কমপক্ষে ৬৪ হাজার ৮৭১ জন নিহত এবং ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬১০ জন আহত হয়েছেন।
অনদিকে সোমবার ক্ষুধা-অপুষ্টিতে নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে চারটি ভ্রূণ এবং অকালে জন্ম নেওয়া তিনটি শিশু মারা গেছে। এতে ক্ষুধায় মৃত্যু বেড়ে ১৪৫ জন শিশুসহ ৪২২ জনে দাঁড়াল।
আল জাজিরা জানায়, যুদ্ধ গাজার বাস্তুচ্যুতদের ওপর ভারী চাপ সৃষ্টি করছে। এক বাসিন্দা জানান, গাজা শহরে ইসরায়েলি আক্রমণের আগে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার জন্য মাত্র ১০ মিনিটের নোটিশ দেওয়া হয়। পরিস্থিতি খুবই কটিন। আমরা থাকার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। আরেক বাসিন্দা বলেন, আমাদের চেয়ে প্রাণিরা ভালো জীবন কাটাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষের স্থানান্তরের জন্যও অর্থ জোগাড় করতে পারছে না। আমরা ক্লান্ত।
ইসরায়েলি বাহিনী রোববার মধ্যরাত থেকে গাজার বিভিন্ন এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে আসছে। রেমাল এলাকার একটি তাঁবুতে হামলায় তিন শিশুসহ কমপক্ষে সাত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা শহরের আল-জালায় দুটি বাড়িতে হামলায় কমপক্ষে ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন অনেকে। ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে গাজার শিশুদের লক্ষ্য করে আক্রমণ করছে। গাজায় কর্মরত বিদেশি চিকিৎসকরা বলেন, তারা ১০০ জনেরও শিশুর চিকিৎসা করেছেন, যাদের মাথা বা বুক গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
সূত্র: এপি, এফপি, রয়টার্স