Image description

চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। গুরুত্ব বিবেচনায় পদটি বড় না হলেও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র গ্রুপটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। শেখ রেহানার প্রতিনিধি হিসেবে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন রেলওয়ের সব ঠিকাদারি কাজ। ক্ষমতায় থাকতে বাবর চলতেন মাফিয়াদের মতো। একাধিক বিলাসী গাড়িতে করে মহড়া দিতেন, আগে-পিছে থাকত সশস্ত্র প্রহরা। জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাবর। পুলিশের সঙ্গে একাট্টা হয়ে হামলা চালান শিক্ষার্থীদের ওপর। পুলিশের পাশাপাশি বাবর বাহিনীর হামলায় চট্টগ্রামে নিহত হন পথচারী, শিক্ষার্থীসহ অন্তত পাঁচজন।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাড়ি-গাড়ি-সাম্রাজ্য ফেলে নিরুদ্দেশ হন যুবলীগ সন্ত্রাসী বাবর।

সেই থেকে বাবরের একাধিক বিলাসী গাড়ির খোঁজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা তেমন কিছু উদ্ধার করতে না পারলেও এক বছরের মথায় আড়াই কোটি টাকা দামের ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো (ঢাকা মেট্রো ঘ ১২-৩৯-৬৯) গাড়ির সন্ধান পেয়েছে আমার দেশ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিলাসবহুল গাড়িটি এখন ব্যবহার করছেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও আগামী নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়া থেকে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী কুতুব উদ্দিন বাহার। গাড়িটি নিয়ে রীতিমতো উপজেলাজুড়ে নির্বাচনি প্রচারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। যদিও কুতুবের দাবি, গাড়িটি তিনি শাহ আলম নামে একজনের কাছ থেকে রমজানের আগে কিনেছেন। এই শাহ আলম রেলওয়ের একজন শীর্ষ ঠিকাদার এবং যুবলীগ সন্ত্রাসী বাবরের ব্যবসায়িক অংশীদার। বিআরটিএর রেকর্ডে গাড়িটি শাহ আলমের নামেই নিবন্ধন করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর আগে শাহ আলম নিজেই দুবাই থেকে গাড়িটি আমদানি করেন। ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট বিআরটিএতে তার নামেই নিবন্ধন করে গাড়িটি উপহার দেন বাবরকে। সেই থেকে বাবরই গাড়িটি ব্যবহার করতেন। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতসহ একাধিক জায়গায় গাড়িটি নিয়ে বাবরের মহড়া দেওয়ার ভিডিও আমার দেশ-এর হাতে সংরক্ষিত আছে।

বিআরটিএর তথ্য বলছে, গাড়িটির চেসিস নম্বর টিআরজে ১৫০-০১৬৮৮১১। সর্বশেষ ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে ২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ও বাবর গাড়িটি ব্যবহার করেছেন। সরকার পতনের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকায় শাহ আলমের কাছে গাড়িটি রেখে যান তিনি।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রেলওয়ের ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে বিএনপি নেতাদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেন শাহ আলম। এক পর্যায়ে সন্ধান পান রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন বাহারের। শাহ আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাবরের গাড়িটি তিনি উপহার দেন বাহারকে। আমার দেশ-এর এই রিপোর্টার ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ লেগে থাকা সন্ত্রাসী বাবরের গাড়িটি আবিষ্কার করেন গত ৮ জুলাই। সেদিন জুলাই বিপ্লবের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাঙ্গুনিয়া বিএনপির শোডাউন ছিল। সেদিন বিএনপি নেতা বাহার পুরো উপজেলায় নির্বাচনি মহড়া দেন। কয়েকশ মোটরসাইকেলের মাঝে বিলাসী ছাদখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে উপজেলাবাসীকে শুভেচ্ছাও জানান তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতা বাহার আমার দেশকে বলেন, ‘গাড়িটি আমি শাহ আলমের কাছ থেকে কিনেছি। এই রমজানের আগের রমজানেই কেনা।’ বাবরের ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবর হয়তো অন্য কোনো গাড়ি ব্যবহার করতেন। একই রঙের অনেক গাড়িই তো আছে।’ পরে তিনি গাড়ি কেনার কিছু স্ট্যাম্প কপি এই রিপোর্টারের কাছে সরবরাহ করেন। তবে সেখানে কোনো তারিখ উল্লেখ ছিল না। দস্তাবেজ অনুযায়ী, গাড়িটি এক কোটি ৫৫ লাখ টাকায় কিনেছেন তিনি।

বিআরটিএর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা বলেন, সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী কোনো গাড়ির মালিক গাড়িটি বিক্রি করলে হস্তান্তরের ৩০ দিনের মধ্যে বিআরটিএ থেকে নতুন মালিকানার নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় গাড়ি রাস্তায় চালানো আইনত অবৈধ।

জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, এক বছর আগে জালাল উদ্দিন নামে ঢাকার এক ব্যক্তির কাছে গাড়িটি বিক্রি করেন তিনি। তবে গাড়িটি বাবর ব্যবহার করতেন কি না, এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

কে এই বাবর

ঠিকাদারি কাজ-সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা একজন করে কমিশন এজেন্ট রাখতেন। তাদের কাজই ছিল সব ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ করা। কোন ঠিকাদার কোন কাজ পাবেন—তা নির্ধারণ করে দিতেন সেই কমিশন এজেন্টরা। বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন পৌঁছে যেত রেহানার মাধ্যমে হাসিনার কাছে। গণপূর্তের কমিশন এজেন্ট ছিলেন ঢাকার যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, আর রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন চট্টগ্রামের যুবলীগ সন্ত্রাসী বাবর।

মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে প্রতিপক্ষরা ভাগ বসাতে চাইলে বাবর বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। ২০১৩ সালে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামের সিআরবিতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গোলাগুলিতে শিশুসহ দুজন নিহত হন। ওই মামলার প্রধান আসামি বাবর। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও হাসিনা-রেহানার আশীর্বাদে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে।

এছাড়া ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল নগরের আউটার স্টেডিয়ামে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে নন্দনকানন এলাকায় আজাদ আলী খানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন বাবর। ২০১৪ সালে এ মামলায় খালাস পেয়ে ১০টি গরু জবাই করে মেজবান দেন তিনি। ২০২৩ সালে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগে কর্মরত এক ফিল্ড অফিসারকে তার কথার বাইরে কাজ করায় অফিস চলাকালীন সময়ই তুলে নিয়ে গিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

সবশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় বাবর বাহিনী। ওইদিন একটি সাদা এক্স করোলা গাড়িতে করে বস্তাভর্তি অস্ত্র এনে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সন্ত্রাসীদের মাঝে বিতরণ করেন বাবর। সেদিন পুলিশ ও বাবর বাহিনীর যৌথ হামলায় নিহত হন ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, শিবির নেতা ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও পথচারী ফারুক। ৪ আগস্ট সকালে নিউ মার্কেট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে একাট্টা হয়ে ছাদখোলা জিপে করে গুলি করতে করতে শিক্ষার্থীদের জমায়েত ছত্রভঙ্গ করে দেয় বাবরের সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই হামলায় আইনজীবীসহ অন্তত ৭০ জন গুলিবিদ্ধ হন।