গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে এ অবস্থার অবসান হবে বলে মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ। আর নির্বাচনে যে দলটি সরকার গঠনে সবচেয় এগিয়ে তার নাম বিএনপি। দলটির প্রধান লম্বা প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে ফেরেন ২৫ ডিসেম্বর। এরপর থেকেই তাকের রহমানকে ঘিরে শুরু হচ্ছে রাজনীতির নতুন পর্ব।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম অভাগা চরিত্র হলো তারেক রহমান। কেননা তিনি দায়িত্ব পাওয়ার আগেই জাজমেন্টের শিকার হয়েছেন। এটা বারবার উনার জীবনে ঘটতে দেখা গেছে। বিগত সরকারের আমলেই তাকে নেতা হিসেবে বা দলীয় প্রধান হিসেবে ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য অনেক ধরনের বয়ান বাজারে চালু করা হয়েছিল। ৫ আগস্টের পরেও উনাকে ব্যর্থ বলে জাজেমন্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ উনি ক্ষমতায় আসেন নাই। পরীক্ষিত হওয়ার আগেই ফলাফল বাতলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে উনার বিষয়ে বারবার।
উনার দলের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায় নাই। চেষ্টা করেও যায় নাই অনেক সময়। অনিয়ম ও অন্যায়ের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েও দলের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের নিষ্পত্তি করা যায় নাই- এটা সত্য; কিন্তু প্রতিপক্ষ দলটিকে উপস্থাপনের সময় যে কু-কৌশলের আশ্রয় নেন তা হলো- দলকে তারেক রহমান রি-প্রেজেন্ট করেন না, রি-প্রেজেন্ট করেন অপরাধী যার বিরুদ্ধে হয়তো একটা নিউজ প্রকাশিত হলো। সে হয়তো সাবেক নেতা বা দলের খুবই ছোট একটি পোষ্টের নেতা কোনো একটা গ্রামের। কিন্তু তাকেই বানিয়ে দেওয়া হলো বিএনপির প্রতিচ্ছবি। বয়ানে পাওয়া যাচ্ছে- বিএনপিকে রি-প্রেজেন্ট করেন সেই লোকাল অপরাধী, তারেক রহমান নন। এক ধরনের বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরা এ ধরনের বয়ান লম্বা সময় ধরে তৈরি করেছেন। উনাকে আন-কালচারড, আন-সলিটিকেটেড হিসেবে সব সময় উপস্থাপন করা হতো বুদ্ধিজীবীদের ভাষ্যে ও মূলধারার মিডিয়ায়। এখনও তথাকথিত ডানপন্থিরা বা বিরোধী প্রতিপক্ষরা এই তরিকা ফলো করছেন উনাকে ঘায়েল করতে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে এটার সয়লাভ লক্ষ্য করা যায়।
এভাবেই ন্যারেটিভ পলিটিক্স করে তারেক রহমানের চরিত্র হননের কাজটি লম্বা সময় ধরেই করে আসছে বিভিন্ন গ্রুপ। এই কাজে দুই আমল মিলিয়ে মূলধারার মিডিয়া ও সোশ্যল মিডিয়া বিপুলভাবেই তারেক রহামনের বিরুদ্ধে ছিল এবং আছে বলা যায়। এমন অবস্থায় তিনি দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরছেন। তাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে দলের ভেতরে ও বাইরে। প্রচন্ড কঠিন একটা বাস্তবতায় তাকে রাজনীতির মাঠে স্ব-শরীরে নামতে হচ্ছে। এতো দিন তিনি দূরে থেকে দলের দায়িত্ব পালন করেছেন । ফলে একদিকে তার প্রতি বিপুল প্রত্যাশা এবং অন্যদিকে তার জন্য বিপুল চ্যালেঞ্জের মধ্যে ভারসাম্যই যে তার সফলতা বা ব্যর্থতার বিষয়টি নির্ধারণ করবে এবং এটাই যে আগামীতে বাংলাদেশের ভাগ্য অনেকখানি নির্ধারণ করে দিবে বলাই বাহুল্য।

ন্যারেটিভ রাজনীতি
তার চরিত্রের বেশ কিছু ইউনিক দিক আছে যা বাংলাদেশের রাজনীতির সংষ্কৃতির জন্য প্রচন্ড বেমানান। এজন্য তাকে নিয়ে ভুয়া ন্যারেটিভ পলিটিক্স তৈরি খুবই সহজ হয় অনেক সময়। তার বিষয়ে ভারত-আওয়ামী লীগ, জামায়াত প্রত্যেকের পজিশন একই রকম। তাকে অযোগ্য ও অজনপ্রিয় মনে করতে তারা পছন্দ করেন। কেন এটা মনে করার সুযোগ তৈরি হয়? বাংলাদেশে নেতাদের এক ধরনের আইরন ম্যান ও কঠোর হুঙ্কার দিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। প্রচন্ড রাগি ও দানবীয় বা অনেকটা তামিল সিনেমার নায়কের মতন মনে করা হয়। হাসিনার দানবীয়তাকে অনেকে দক্ষতা ও যোগ্যতা হিসেবে প্রচার করতো। সেখানে তারেক রহমান খুবই মৃদু ভাষ্যে কথা বলেন। কোন চিৎকার, হুঙ্কার নাই। ফলে তাকে ঠিক নেতাই মনে হয় না- প্রচলিত জনপ্রিয় পাবলিক-কল্পনার আলোকে। অন্যদিকে তিনি খুবই সাদামাটাভাবে জীবনযাপন করেন ও জনগণের সামনে হাজির হন; যা ইউরোপে অনেক জনপ্রিয় স্টাইল হলেও আমাদের দেশে নেতাকে কিং বা রাজার মতন মনে করা হয়। তার জৌলুস থাকবে– এটাই যেন স্বাভাবিক। নিজেদের থেকে উন্নত ও সেরা মনে করা হয়। এটা হয়তো কলোনিয়াল সাইকীর প্রভাব; কিন্তু এটা জনগণের মধ্যে আছে। ফলে তারেক রহমানকে বেশির ভাগ সময় মনে হয় আমাদের মতোই খুব সাধারণ একটা মানুষ। যার মধ্যে বিশেষ কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি কথা-বার্তাও অনেক বিনয়ী, ফলে তাকে সব মিলিয়ে খুবই আটপৌরে একটা নরমাল মানুষই মনে হয়। তাকে কেন্দ্র করে মিথ বা গল্প-কাহিনী তৈরি করার মতন সুযাগ নাই। মিথ অব স্টং লিডারশিপের বিপরীত একটা চরিত্র তিনি। ফলে খুব দুর্বল প্রতিপক্ষও তাকে সরাসরি আক্রমণ করে ফেলতে পারে। তাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই বিপুল সমালোচনার মধ্যে পড়তে দেখা যায়। যার বেশির ভাগই ভুয়া ও মিথ্যা অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই করা হয় এবং এসব প্রবণতাকে কাউন্টার করার কোনো রাজনৈতিক প্রস্তুতিও তার দলের নাই। কারণ এ দলটি একক মতাদর্শবাদী দল না। বিভিন্ন মতাদর্শ ধারণ করা মানুষ এখানে আছে। আর দলটি মধ্যপন্থার গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার চেষ্টা করছে শুরু থেকেই। ফলে একটা আদর্শবাদী কাল্ট-ফিগার দেখতে জনগণ যেখানে অভ্যস্ত সেখানে এমন সাধারণ একজন নেতা কী করে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন? মিডিয়াতে যার কোনো খবর প্রচার নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল লম্বা সময়- তিনি কিভাবে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন? নীরবে এতেটা জনপ্রিয় কিভাবে হলেন? এতটা আস্থার প্রতীক কিভাবে তাকে মনে করা হচ্ছে? হাসিনার পতনের সাথে সাথে আমরা মিথ্যা ন্যারেটিভ পলিটিক্সের যুগ পার করে পোষ্ট ন্যারেটিভ যুগে প্রবেশ করে গিয়েছি। এটা হয়তো প্রতিযোগী অনেক দলই অনুধাবন করতে পারে নাই। তাই সেই পুরোনো আমলের মতন করে নিজেদের প্রয়োজেন ভুয়া বয়ান তৈরি ও অন্যের চরিত্র হনেন প্রচেষ্টা করে; কিন্তু জেন-জি এবং সাধারণ মানুষ এখন সরাসরি, ভনিতাহীন আচরণ পছন্দ করেন।
উনার জনপ্রিয়তার এটা একটা কারণ। আর একটা অন্যতম কারণ হলো হাসিনার আমলে মিডিয়া উনাকে বয়কট করলেও -উনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন, তৃণমূলের নেতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন বেশি। বড় বড় নেতাদের চেয়ে গ্রামের সাধারণ নোতদের সাথে সরাসরি বেশি কথা বলতেন। এর মাধ্যমে তৃণমূলের সাথে উনার একটা সংযোগ গড়ে উঠেছে। আর সাদামাটা চলনের কারণে- ন্যারেটিভ রাজনীতি ও প্রতিপক্ষের প্রোপাগান্ডার পরেও সাধারণ মানুষের একটা অংশ তাকে নিজেদের মতনই মনে করেন। তাকে দূরের কেউ মনে করেন না। এজন্য একটা আবেগ ফিল করেন। এই কারণে প্রচলিত ধারার নেতার মতোন করে তার ব্যক্তিত্বের পূজারি তৈরি না হলেও তার একধরনের নীরব জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। এখন যার খানিকটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ভিকটিম কার্ড
আবেগ গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবেগই কোনো কোনো সময় আপনার নিয়তি নির্ধারণ করে দিতে পারে। আপনি যদি ঠিকমতো ভিকটিম কার্ড প্লে করতে পারেন আপনি জিতে যাবেন। জনগন আপনাকে সমর্থন করতে শুরু করবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার এটার সেরা ব্যবহার করেছে; কিন্তু তারেক রহমান কখনও এই কার্ড প্লে করে নাই। তিনি নিজে অনেক বড় নির্যাতনের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। যার আবেগি গল্প বলে জনগণকে কাঁদায়ে ফায়দা নেওয়াটা খুবই সহজ কিন্তু তিনি এ সহজ কাজটি করেন নাই। বরং বিগত ১৭ বছরে তার দলের নেতা-সমর্থকদের হাজার হাজার পরিবার এতটা নির্যাতন সহ্য করেছেন যে, সেখানে তার নিজের গল্পটা বাজারজাত করাটা খুবই অশোভন দেখায়- এটা উনি একবার এক আলাপে বলেছেন। অন্যের কষ্টের চেয়ে নিজের কষ্টকে বড় করে দেখানো এবং এর রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করা এক ধরনের কপটতা। তিনি সচেতনভাবে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকেন। এটা ধীরে ধীরে মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করেছে বলেই মনে হয়। উনার ব্যক্তিত্ব বিষয়ে একটা পজিটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে এতে। ভিকটিম হুডের রাজনীতি বিপজ্জনক- “ভিকটিমস বিকাম কিলারস”।
সচেতন মানুষ উনার এ ধরনের চরিত্রের প্রতি ধীরে ধীরে আস্থাবান হতে শুরু করেছেন। উনাকে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী নেতা মনে না করে সমষ্টির কথা চিন্তা করতে পারেন- এমন একজন নেতা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরে যে নাগরিকভিত্তিক রাষ্ট্র মানুষ প্রত্যাশা করে- তাতে সে নিজেও যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই বোধ জেগে ওঠেছে আর তার উপযোগী নেতা হিসেবে তারেক রহমানকে বেশি প্রেফার করছেন রাজনৈতিক সচেতন মানুষ।
ট্রুথ অ্যান্ড পলিটিক্সি
বাংলাদেশে পলিটিক্যাল ট্রুথ খুব জনিপ্রিয়; যা মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর এবং ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য মিথ্যা নয়, এই পলিটিক্যাল ট্রুথই বড় অস্ত্র ছিল। এই কাঠামোতে তারেক রহমান এলে কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন। উনার বিরুদ্ধে যখন মিথ্যার জোয়ার উঠে। কখনও কখনও যা জনপ্রিয়তাও পায় স্বল্প সময়ের জন্য; তখনও তিনি সেই সব অভিযোগের বিষয়ে নীরব থাকেন। অত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেখা যায় না বললেই চলে। নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে চিৎকার করতে দেখা যায় না। মিথ্যার বিরুদ্ধে চুপ থাকা এবং তাকে একা একাই পরাজিত হতে দেওয়া এবং নিজের সঠিক কাজটি করে যাওয়া একটা প্রচন্ড ধৈর্যশীল নীতি। এটাই তিনি নিয়ে থাকেন। মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সময় নষ্টের চেয়ে সঠিক কাজটি করা জরুরি বলে মনে করেন। উনার বিরুদ্ধে হাসিনা আমলের মিথ্যাগুলো হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে পরাজিত হলো। আর ৫ তারিখের পরেও উনাকে নিয়ে যে মিথ্যাটা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল তা হলো- উনার মা মারা যাচ্ছেন আর তিনি দেশে আসছেন না। তিনি আসলে দেশে আসবেন না। নির্বাচনের কঠিন পরীক্ষায় তিনি নিজে নামবেন না। দূরে থেকেই তিনি কাজ করবেন। আর এসে ক্ষমতার চেয়ারে বসবেন। উনার দেশে আসাকে কেন্দ্র করে তার প্রতিপক্ষ দলের একভিন্ট ও কমেটেটররা হেন কোনো উদ্ভট কথা নাই যা প্রচার করেন নাই; কিন্তু তিনি সব মিথ্যা ও জল্পনাকে নৎসাত করে দিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বাংলোদেশে আসার ঘোষণা দিলেন। ফলে তাকে নিয়ে যারা মিথ্যা বয়ান এতদিন প্রচার করল তারা নৈতিকভাবে পরাজিত হলো। ট্রুথ অ্যান্ড পলিটিক্সকে একসাথে ধারণ করার এই কঠিন কাজটি তাকে করতে হচ্ছে। এটাও বাংলাদেশের রাজনীতির কালচারের একদম বিপরীত একটা প্রবণতার দিকে যাত্রা; কিন্তু এটা তাকে লম্বা সময়ের জন্য জনগণের আস্থা অর্জনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যারা তার কাজে অসন্তষ্ট, বিরক্ত তারাও তাকে অবিশ্বাস করতে পারছে না। তিনি সব বিষয়ে সফর না হতে পারেন তিনি প্রতারক নন– এটাই বড় পাওয়া বাংলাদেশের জনগণের। এমনকি তার শত্রুরাও যে তার কাছে নিরাপদ তা তিনি হাসিনা পতনের পরে তার ৫ তারিখের আলোচনাতেই পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন- আপনার শত্রু যদি আপনার হাতে নিরাপদ না থাকে তাহলে আপনার বিজয়ের কোনো গৌরব থাকবে না। আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। দেশে মানুষের জান-মাল ও সম্পদ রক্ষার জন্য জনগণকে তিনি এগিয়ে আসার আহবান জানান। হাসিনার পর দেশে গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তখন তিনি হাসিনার আদলে প্রতিশোধের রাজনীতি না করে, উল্টো জাতি গঠনের রাজনীতি শুরু করেছেন; যা ঐতিহাসিক এক গুরুত্ব বহন করে।
এক সময় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বড় বড় দুটি পত্রিকা- ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাকে ভিলেন বানানোর প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে । তাদের অফিসে সম্প্রতি সন্ত্রাসীরা আগুন দেওয়ার পরে তার দলই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে।
সম্প্রতি একটা মতবিনিময় সভায় সেই পত্রিকার সম্পাদকদ্বয়কে দাওয়াত দিয়ে তাদের গঠনমূলক সমালোচনার আহবান জানানো হয়েছে। অবশ্য সেখানে তারা উনার প্রশংসাই করেছেন। এটাও এক ধরনের মোরাল ভিকটরি বলতে হবে। যারা তার চরিত্র হননে সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন আজ তারাই তার প্রশংসা করতে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছেন; যা অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য ভালো কোনো কথা নয়; কিন্তু এটা অর্জন করতে তাকে বিপুল ধৈর্য এবং সত্যকে আঁকড়ে থাকার মানসিকতার পরিচয় দিতে হয়েছে। সত্য শেষপর্যন্ত জয়ী হবে। মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রকারীরা পরাজিত হবে- এমন সরল বিশ্বাসে আস্থা রাখা সব সময় সহজ না। এতে অনেক ক্ষতির মধ্যেও পড়তে হয় সাময়িকভাবে; কিন্তু এটাই সঠিক পথ। আমি সাময়িকভাবে বিপদে থাকতে পারি কিন্তু নিজেকে শুধরে নিয়ে শেষপর্যন্ত আমি যদি সত্যের পথে থাকি- সত্য যেহেতু শেষপর্যন্ত বিজয়ী হবে; ফলে সূত্রমতে আমারও বিজয় নিশ্চিত।

সামনে কঠিন পরীক্ষা
বাংলাদেশের নেতারা দেশকে কথায় কথায় ইউরোপ-আমেরিকা বানাতে চান। তিনি লম্বা সময় লন্ডনে থেকেও দেশকে লন্ডন বানাতে চান না। তিনি বাংলাদেশকে বাংলাদেশ বানাতে চান। সবার জন্য মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে চান। চাকরির সুযোগ তৈরি করত চান। কৃষি ও শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে চান- তার জন্য কিছু ব্যবহারিক পরিকল্পনা ও পলিসি নিয়ে কাজ করছেন। কথা বলছেন; যা করতে পারবেন না, এখন করা সম্ভ না- তাও বলছেন। আকাশকুসুম কোনো স্বপ্ন দেখাচ্ছেন না। সরকারের সব সংস্কার প্রস্তাবে সাড়াও দিচ্ছেন না; যা সম্ভব না তা পরিষ্কার করে বলছেন। এতে বিরোধীরা তাকে সংস্কারবিরোধী বলে ট্যাগ করছে। যদিও তিনি ৩ বছর আগেই ৩১ দফার সংস্কার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। মোট কথা, জনগণের কাছে ট্রান্সপারেন্ট থাকার চেষ্টা করছেন এটা উনাকে দিন দিন শক্তিশালী করছে।
সব মিলিয়ে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে এগোতে চাচ্ছেন। জনগণের সঙ্গে যাতে বিগত সরকারের মতো তার প্রতারণার সম্পর্ক তৈরি না হয় সেটাই তিনি চাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। এজন্য তিনি অসম্ভব স্বপ্নের কথা বলছেন না। বরং বলছেন দেশকে কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে। সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাস্তবতা হাজির হয়েছে। তাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে যে ধরনের সংগঠন দরকার সেটার আলোকে বিএনপিকে গড়ে তোলা অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। দলটি কোনো মতাদর্শবাদী দল না। বরং দলটি মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতি করে। ফলে উন্নত ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মেধাবীদের দিয়ে দলটি নতুন করে সাজানো ছাড়া তার পক্ষে জাতীয় নেতা হিসেবে সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। বিএনপি মতাদর্শবাদী না মূল্যবোধভিত্তিক দল। ফলে মূল্যবোধসম্পন্ন নেতাদের সমন্বয়ে জনগণের জন্য সেবামূলক রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই মূল কাজ হবে।
বিএনপি নেতা হিসেবে উনি সফল। দলকে ভাঙন থেকে রক্ষা করে গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়া পর্যন্ত নেতৃত্ব দেওয়ায় উনার সফলতা প্রমাণিত কিন্তু এখন উনাকে জাতীয় নেতা হিসেবে সফল হতে হবে। অনেক অন্ধ মতাদর্শবাদী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে হবে। অল্ট্রা ফ্যাসিস্টদের সাথে লড়তে হবে। যাদের প্রধান অস্ত্র মিথ্যা ন্যারেটিভ রাজনীতি; যা সহজেই জনগণকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। রাষ্ট্রের ভেতরে যারা রাষ্ট্র গড়ে তুলে। ভারতের সাথে উনাকে অবশ্যই খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে ডিল করতে হবে। একদিকে প্রচন্ড ভারতবিরোধী জোয়ার, অন্যদিকে ভারতের সাথে একটা মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক দেশের স্থিতিশীলতার জন্যই জরুরি। ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের পর থেকেই ভারত উনাকে ভালোভাবে দেখে না- এটা সবাই জানে; কিন্তু বিরোধীরা উনাকে ভারতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রচার করে বিভিন্ন ভুয়া ফটোকার্ড ও নিউজ প্রায়ই ছড়াতে দেখা যায়। ফলে দেশের ভেতর মানে- চলতি ক্ষমতা বলয়ের ভেরত সিন্ডিকেট, সেনাবানিহী, দলের ভেতর সিন্ডিকেট এবং প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক কতটা সফলতার সাথে তিনি ডিল করতে পারেন তার ওপর উনার সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করবে।
একজন বিএনপি দলীয় নেতার চেয়ে বরং তাকে জতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জাতীয় নেতা বা রাষ্ট্রনায়কসুলভ ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারাই উনার জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে বিএনপি নয়, জাতীয় নেতা হিসেবে উনার সফলতা বা ব্যর্থতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে লম্বা সময়ের জন্য গভীরভাবে প্রভাবিত করবে– এটা বলাই যায়।
(লেখাটি ইংরেজি সংস্করণ ভারতীয় পত্রিকা thewire.in -এ ২৫ ডিসেম্বর ‘Tarique Rahman Returns: What Kind of Leader Will He Be in a Fractured Bangladesh?’ শিরোনামে মতামত হিসেবে ইশৎ সংক্ষেপে ছাপা হয়েছে)।
লেখক: চিন্তক ও সম্পাদক জবান