অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে একটি উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা ও ‘থ্রি জিরো’ বা তিন শূন্যের পৃথিবী ধারণার কারণে বিশ্বব্যাপী যিনি সমাদৃত।
সঙ্গত কারণেই দেশের মানুষের মনে এই প্রতীতি জন্মেছিল যে, বিগত বছরগুলোয় রাষ্ট্রীয় অনিয়ম, বিশেষ করে লাগামহীন দুর্নীতি ও নাগরিক হরানির মধ্য দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে গণবিরোধী হয়ে উঠেছিল, অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার সেখান থেকে মানুষকে মুক্তি দেবে। সেইসাথে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রেখে মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করবে। রাজনৈতিক তথা আদর্শিক মতভিন্নতার কার্ড ব্যবহার করে অতীতে যেমন পুরো জাতিতে বিভাজিত করে রাখা হয়েছিল, এই সরকার তার বিপরীতে এমন একটি ঐক্য গড়ে তুলবে—যেখানে সহনশীলতাই ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাই হবে মূল কথা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে মানুষে মানুষে বিভাজন অনেক বেড়েছে। বিগত দিনগুলোয় যেসব ইস্যুতে মানুষের মতপার্থক্য ছিল কেবল চায়ের টেবিলে, এখন সেসব ইস্যু নিয়ে মতবিরোধ এতটাই স্পষ্ট যে, পুরো জাতি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। আর এই বিভাজনটি তৈরি হয়েছে মূলত নানা কর্মকাণ্ডে সরকারের নির্লিপ্ত থাকা তথা প্রশ্রয় ও সমর্থন দেয়ার কারণে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মীয় ইস্যুতে।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকার ও তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের অসংখ্য উদ্যোগ ও তৎপরতায় মনে হয়েছে, তারা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নির্মূল করতে গিয়ে পুরো দেশের মানুষকে আওয়ামী লীগের পক্ষ ও বিপক্ষ—এই দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। অথচ এর বাইরেও প্রচুর মানুষ রয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থক ও ভোটারদেরকেও দলের দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে তাদেরকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলে আখ্যা দিয়ে প্রান্তিক করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক নন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তরের সংবিধান ইস্যুতে কথা বলার কারণেও অনেককে আওয়ামী লীগের দোসর ট্যাগ দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। যেমন বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক ভিন্নমতের লোকদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে ওই শ্রেণিটাকে নির্মূল করার চেষ্টা চলতো। অর্থাৎ অভ্যুত্থানের পরেও রাজনীতির এই নির্মূলিকরণ বন্ধ তো হয়ইনি, বরং বেড়েছে—যা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এই দেশে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাড়িতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে যার যার ধর্ম চর্চার মধ্য দিয়ে—যেখানে মাগরিবের আজারে সঙ্গে শঙ্খধ্বনির কোনো সংঘর্ষ হয়নি। এরকম একটি দারুণ ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’তে ধর্মের নামে বিভাজন বা ধর্মীয় উগ্রতা প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা গত এক বছর ধরে চলছে, সেটি অত্যন্ত লজ্জার এবং জুলাই অভ্যুত্থানের পরে যে উগ্রবাদী ও কট্টরপন্থি গোষ্ঠীটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলো—সেটিও অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসানের পরে দেশের মানুষের মধ্যে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সেই পরিবর্তনটি কোথাও যে দৃশ্যমান নয়, সেটি স্পষ্ট।
গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশে যে অভুতপূর্ব অভ্যুত্থানটি হলো, সেখানে মূল স্লোগান ছিল বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে গত এক বছর ধরে রাষ্ট্রের কোথাও বৈষম্য কমার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। বরং বেড়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে অসংখ্য মানুষকে নির্মূল করে দেয়ার চেষ্টা চলছে, যার পেছনে আছে প্রতিহিংসা। বাস্তবতা হলো, হিংসা ও প্রতিহিংসা দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় না।
বাস্তবতা হলো, শান্তিতে নোবেলজয়ী একজন মানুষের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের আমলেই বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সবচেয়ে খারাপ চেহারাটি দেখছে। এই সরকারের আমলেই মানুষ দেখছে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মু্ক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের অবমাননা। এই সরকারের আমলেই মানুষ শুনছে মুক্তিযুদ্ধের এমন সব বয়ান—যা ১৯৭১ সালে এই দেশে প্রাণ দেয়া লাখ লাখ মানুষের আত্মদানকে হেয়প্রতিপন্ন করে। মুক্তিযুদ্ধের এমন সব বয়ান সামনে আনা হচ্ছে যা স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী তথা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তিগুলো বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষের আমলেই দেশে ধর্মের নামে উগ্রতা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কথিত তৌহিদী জনতার আস্ফালন শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং শান্তি ও সহনশীলতার ধর্ম ইসলাম সম্পর্কেও একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে—যা দেশের বাইরেও জুলাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু উগ্র নয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মডেলে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাইলে সেটা এই দেশের অধিকাংশ মানুষই সমর্থন করবে না। কারণ এই দেশে অসংখ্য সুফী সাধক যেমন ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন—তেমনি এখানেই জন্মেছেন লালন। এই দেশের মাটি ও জলবায়ুর সঙ্গে মিশে আছে সহজিয়া, একটি উন্নত সংস্কৃতি, লোকগান আর মজবুত পারিবারিক কাঠামোর এক অনন্য সামাজিক ঐতিহ্য। এই দেশের নারীরা ঘোমটা পরে সেই আদিকাল থেকেই। আবার রাত জেগে তারা যাত্রা ও পালাগানও দেখেছে।
এই দেশে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাড়িতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে যার যার ধর্ম চর্চার মধ্য দিয়ে—যেখানে মাগরিবের আজারে সঙ্গে শঙ্খধ্বনির কোনো সংঘর্ষ হয়নি। এরকম একটি দারুণ ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’তে ধর্মের নামে বিভাজন বা ধর্মীয় উগ্রতা প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা গত এক বছর ধরে চলছে, সেটি অত্যন্ত লজ্জার এবং জুলাই অভ্যুত্থানের পরে যে উগ্রবাদী ও কট্টরপন্থি গোষ্ঠীটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলো—সেটিও অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসানের পরে দেশের মানুষের মধ্যে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সেই পরিবর্তনটি কোথাও যে দৃশ্যমান নয়, সেটি স্পষ্ট।
মনে রাখা দরকার, হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশের মানুষের যে মানসকাঠামো—সেখানে কোনো ধরনের উগ্রতা বা ধর্মান্ধতা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সফল হবে না। মধ্যপ্রাচ্যের নদীবিহীন শুষ্ক মরু কিংবা আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড় আর রুক্ষ্ম আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষের চিন্তা-বোধ ও দর্শনের সাথে নদী ও সবুজ প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা সহজ-সরল বাংলার মানুষের চিন্তার কাঠামো কখনোই মিলবে না। এই দেশের মানুষ রাত জেগে ইসলামের ওয়াজ-মাহফিল যেমন শোনে, তেমনি পালাগানও শোনে। এটিকে মানুষের মনোজগতের দ্বান্দ্বিক অবস্থা না বলে বরং বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা ও বোধের সৌন্দর্য বলাই শ্রেয়। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের গত এক বছরে এই সৌন্দর্যের ওপরেই সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে। অথচ এই সময়ের বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দেশের মৌলিক চিন্তা ও আদর্শগুলোর চর্চা হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তা হয়নি। বরং এমন অনেক কিছু ঘটেছে এবং ঘটছে—যা বহু বছর ধরে চলে আসা রাজনৈতিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী একজন অর্থনীতিবিদ এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালে নতুন রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তার অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ৮০ শতাংশের বেশি মুসলমান অধ্যুষিত একটি দেশের সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যুক্ত করতে হয়েছিল এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরেও এই দেশ থেকে কেন ধর্মীয় উগ্রবাদ দূর করা গেলো না; কেন কথিত তৌহিদ জনতার নামে সমাজের কিছু মগজপঁচা লোক, কিছু পলিটিক্যাল টাউট, কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী, কিছু সামাজিক কীট ইসলামের নামে নিজেদের মত ও আদর্শ চাপিয়ে দিতে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে এখনও বিভাজন তৈরি করে রাখতে পারছে; কেন এই গোষ্ঠীর লোকেরা সমাজের বিরাট অংশের মানুষের সমর্থন পাচ্ছে—এই প্রশ্নগুলোর সুরাহা করা জরুরি।
পরিশেষে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিকে অনেকেই ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সেই নতুন বাংলাদেশের যে চেহারাটি গত এক বছর ধরে দেশের নানা প্রান্তে দেখা যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে, নতুন বাংলাদেশেও পুরোনো অসুখগুলো বিদ্যমান রয়ে গেছে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।