বাংলাদেশের দুয়ারে যখনই নির্বাচন করাঘাত করে তখনই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচনী জোট বা ফ্রন্ট গঠনের তোড়জোড় পড়ে যায়। এবার তোড়জোড়টা অনেক বেশি। কারণ, সুদীর্ঘ ১৭ বছর পর মানুষ ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তাই এবার ভোটারদের মধ্যে যেমন ভোট দেয়ার সুতীব্র আকাক্সক্ষা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জোট বাধার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মঙ্গলবার ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর মোতাবেক এপর্যন্ত ৫টি নির্বাচনী জোট গঠিত হয়েছে। এগুলো হলো, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। এই জোটে বিএনপি ছাড়াও রয়েছে, ৬ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি, মোস্তফা জামাল হায়দার), গণ অধিকার পরিষদ, এলডিপি (অলি আহমেদ), এলডিপি (শাহাদত হোসেন সেলিম), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণফোরাম।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ৮ দলীয় জোট। জামায়াত ছাড়াও এই জোটে রয়েছে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতাদের পার্টি এনসিপি ৩টি দল নিয়ে আরেকটি জোট গঠন করেছে। এনসিপি ছাড়া এই জোটের আর ২ সদস্য হলো, এবি পার্টি এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। বাংলাদেশের বামরা মিলে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট নামে ৯ দলীয় জোট গঠন করেছেন। ৯ দলীয় জোটের সদস্যরা হলো, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি),বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও বাসদ (মার্কসবাদী), শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ এবং পরলোকগত বামপন্থি নেতা পংকজ ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠিত ঐক্য ন্যাপ। এই ৫টি জোট ছাড়াও ২০টি রাজনৈতিক দল জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বা এনডিএফ নামে আরেকটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছে। এই দলের সদস্যরা হলো, জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় ইসলামিক মহাজোট, জাতীয় সংস্কার জোট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, স্বাধীন পার্টি, জাতীয় স্বাধীনতা পার্টি, বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, বাংলাদেশ জনকল্যাণ পার্টি, অ্যাপ্লায়েড ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ডেমোক্রেটিক পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। এছাড়া এই জোটের নেতৃত্বে রয়েছে, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি)। জোটের সংখ্যা ৫ হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোট। বামদের জোটে ৯টি দল থাকলেও এদের মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির কিছু পরিচিতি রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে এই কমিউনিস্টরা ৭৭ বছর ধরে রাজনীতি করছে। কিন্তু তারা এই ৭৭ বছরেও জনগণের দল হয়ে উঠতে পারেনি। এবারের নির্বাচনেও তারা কোনো প্রভাব রাখতে পারবে না। সবচেয়ে মজার জোট হলো, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন দুই জাতীয় পার্টির অধীন ২০টি দল। সত্যি বলতে কি, অবশিষ্ট ১৮ দলের নাম ধাম প্রায় কেউই জানেন না। আমাকে এসব নাম খুঁজে বের করার জন্য গুগল এবং চ্যাটজিপিটির আশ্রয় নিতে হয়েছে। আপাতদৃষ্টে এই ২০ দল এবারের নির্বাচনে কোনো ফ্যাক্টর নয়। তবে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী এখনো দেশে রয়েছেন এবং হাসিনার ১৫ বছরের দুঃশাসন অবসানের পর যারা জনরোষ থেকে বেঁচে গেছেন তারা ব্যারিস্টার আনিস এবং মঞ্জুর জোটের ঘাড়ে সওয়ার হলে বিস্মিত হবো না। আওয়ামী লীগ তাদের ঘাড়ে কতটা চেপে বসছে বা তারাই বা আওয়ামী লীগকে কতখানি ধারণ করছেন সেটি তফসিল ঘোষণার পরেই বোঝা যাবে।
এনসিপির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট মোট ভোট এবং আসন সংখ্যার দিক দিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখতে পারবে বলে মানুষ মনে করেন না। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাদের প্রতি অনেক মানুষের একটি সহানুভূতি থাকতে পারে। কিন্তু বিগত ১ বছরে এনসিপি এমন কোনো ম্যাচিউরিটি দেখাতে পারেনি যে, এই নির্বাচনে তারা একটি বড় ফ্যাক্টর হবে। তবে নির্বাচনের পর এনসিপি তথা গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট নির্বাচনে না হলেও নির্বাচনোত্তর রাজনীতিতে ধীরে ধীরে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা শুরুতেই বলেছি যে, আগামী নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ২টি জোটের মধ্যে। একটি হলো, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। আর একটি জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোট। গত ১০ মাস হলো, আমরা আগামী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বেশ কয়েকটি জরীপ দেখেছি। আমি এসব জরীপকে আমলে নেই না। কারণ, শুধু বাংলাদেশ কেনো, ভারত ও আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশেও এসব নির্বাচনী পূর্বাভাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক হয় না। আমরা বরং আলোচনা করবো নির্বাচনোত্তর রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষিত সচেতন জনগোষ্ঠী ছাড়াও আমজনতার মাঝেও ধানের শীষের একটি আবেদন আজও রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ৮ ডিসেম্বর বলেছেন যে, বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে। সেই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়।’ গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সংসদ নির্বাচনে ‘প্রার্থী নয়, ধানের শীষই মুখ্য’ বলে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আজ আমাদের বসে থাকার সময় নেই। বিভিন্ন এলাকায় আমাদের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। হয়তো এমনও হতে পারে, তোমার এলাকায় যেই প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে দলের পক্ষ থেকে, হয়তো তুমি একজনকে পছন্দ করতে, সে হয়তো পায়নি। যে পেয়েছে তার সঙ্গে হয়তো তোমার সম্পর্ক আছে একটু কম।’ তারেক রহমান বলেন, ‘ভাইরে তুমি তো প্রার্থীর জন্য কাজ করছো না, তুমি তো তোমার ধানের শীষের জন্য কাজ করছো। এখানে প্রার্থী মুখ্য নয়, এখানে মুখ্য হচ্ছে তোমার দল বিএনপি, এখানে মুখ্য হচ্ছে ধানের শীষ, এখানে মুখ্য হচ্ছে দেশ। মানুষ ধানের শীষের পক্ষে রায় দিলে দেশ গড়ার প্রতিটি পরিকল্পনা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো এবং করবো ইনশাআল্লাহ।’ ধানের শীষের জন্য জনগণের মধ্যে এখনো আবেগ রয়েছে বলেই তারেক রহমান বলেছেন যে, জনগণ প্রার্থীকে ভোট দেবে না, দেবে ধানের শীষে। একারণে দেখা যায় যে, বিএনপির মিত্ররা নিজেদের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জয়লাভ করতে পারবেন কিনা সে নিয়ে সুধী সমাজ এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভ করার পক্ষে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় এ্যাসেট বা সম্পদ হলো, জীবন্ত কিংবদন্তী দেশমাতা খালেদা জিয়া। তার এবারের অসুস্থতার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে যে, বিগত ৫৪ বছরে তিনিই বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনগণের নয়নের মণি। এসব কারণে বিএনপি ক্ষমতায় যাচ্ছে- সেটি ধরে নেয়ার পরেও সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাচনোত্তর বিএনপি সরকারের রাজনীতি কি হবে? তার গন্তব্য হবে কোথায়? একটি ওয়েক আপ কল হিসাবে বলা যায় যে, নির্বাচনের আর মাত্র ২ মাস বাকি। কিন্তু এখনো বিএনপি তার রাজনীতি পরিষ্কার করতে পারেনি। আমরা আগেই বলেছি যে, নির্বাচনের পর বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে জামায়াত জোট এবং এনসিপির গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট। প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল মোটেই মিটে যায়নি। এই ঢাকা মহানগরেরই অন্তত ৩টি আসনে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করার পরেও বঞ্চিতরা এখনো তাদেরকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি একাধিক জায়গায় তাদেরকে ভোট দেয়ার জন্য অনেক বড় বড় বিলবোর্ডও টাঙানো হয়েছে। যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদেরকে প্রথমেই মোকাবেলা করতে হবে বিডিআর ম্যাসাকার নিয়ে। মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান তার ৩৬০ পৃষ্ঠার রিপোর্টে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এই গণহত্যার পেছনে দল হিসাবে আওয়ামী লীগ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ, শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী এবং বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত জড়িত। ফজলুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিডিআর গণহত্যার বিচারের দাবি বিএনপি আমলে বুলন্দ হবে।
ভবিষ্যত বিএনপি সরকারকে সামলাতে হবে শাপলা ম্যাসাকারের বিচার। গুম খুনের সাথে জড়িত ১৫ জন সেনা অফিসারের বিচার শুরু হয়েছে। তাদেরকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে কোর্টে আনা নেয়া করা হচ্ছে। এদের বিচারও আগামী বিএনপি সরকারকেই শেষ করতে হবে। ভারতের সাথে নতুন করে সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী মহল এবং ভারতসহ দু’একটি বিদেশি শক্তির প্রবল চাপ রয়েছে। নির্বাচনী তফসিলের পর এই চাপ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে কমে যাবে। পরবর্তী সরকারকে সেই চাপ মোকাবেলা করতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় দল হিসাবে বিএনপিকে হয়তো এই মুহূর্তে জুলাই বিপ্লবে প্রকাশিত জনগণের চাহিদাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে না। তবে জুলাই বিপ্লবের প্রধান দুটি সেøাগান ছিলো স্বৈরশাসন যেনো আর ফিরে না আসে। আরেকটি হলো, “দিল্লী না ঢাকা/ ঢাকা ঢাকা”। মৃত্যুদ- প্রাপ্ত শেখ হাসিনাকে দিল্লীতে আদর যতেœ রেখে দিল্লীর সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করার যে কোনো উদ্যোগ জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে। জামায়াত এবার সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে, এমন ধারণা কেউ পোষণ করেন না। কিন্তু গুঞ্জন রয়েছে যে, ৮টি ইসলামিক দল জামায়াত শিবিরে গেলো। কিন্তু এদের অধিকাংশেরই তো বিএনপির সঙ্গে থাকার কথা। তার ওপর বর্তমান সমস্যার কথা না বলে ৫৪/৫৫ বছর আগের কাহিনী যত বলা হবে ততই মানুষ স্মরণ করবে যে, এগুলোই ছিলো আওয়ামী লীগের ন্যারেটিভ। জনগণ তো বিএনপিকে ইসলামী মূল্যবোধের দল মনে করে। আগামী বিএনপি সরকার দেশে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কতখানি আন্তরিক হবে? এই অভিযোগটিকে উড়িয়ে দিলে চলবে না যে, জুলাই বিপ্লবের পর বিগত ১৬ মাসে সারাদেশে বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ উঠছে। প্রশ্ন উঠছে যে, প্রধান ও শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতেই তারা যেসব কর্ম করছে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলো কি বাড়বে? না কমবে? পরবর্তী বিএনপি সরকারকে ওপরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে হবে।
Email:[email protected]