Image description
 

সংস্কার শব্দটি আজ বহুচর্চিত। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে সংস্কার ভাবনার সূচনা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি স্বাধীনতার পরই ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে এই দেশ নানা সময় ষড়যন্ত্রকারীদের কালো থাবায় পড়েছে, ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও একের পর এক বাধার সম্মুখীন হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। ঠিক সে সময়ে, ২০১৭ সালে ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-পীড়ন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেন ‘ভিশন-২০৩০’। এরই সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান উপস্থাপন করেন ২৭ দফা এবং পরবর্তীতে সব রাজনৈতিক মত-পথকে এক সুতোয় গেঁথে ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৩১ দফা।

 

তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে গভীর গবেষণা ও চিন্তাশীলতায় নিমগ্ন। বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে তিনি সাজিয়েছেন একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নীলনকশা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে বিএনপি এবার গঠনতান্ত্রিকভাবে সেই দেশ গড়ার পরিকল্পনা সামনে নিয়ে এসেছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত “দেশ গড়ার পরিকল্পনা” শীর্ষক কর্মশালায় সারাদেশের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নিয়েছেন, যেখানে স্পষ্ট হয়েছে আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের দীর্ঘদিনের শ্রম, গবেষণা ও সংকল্পের ফল।

এই কর্মপরিকল্পনার অনেক ধারণাই ইতোমধ্যে দেশের চায়ের টেবিল থেকে টক শোয়ের টেবিল, সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বহুদিন ধরে তারেক রহমান যে ভাবনাটি উচ্চারণ করে আসছেন, সেটি হলো : ফ্যামিলি কার্ড, প্রান্তিক পরিবারের নারীর নামে ইস্যুকৃত একটি পরিচয়-এবং-সহায়তা কার্ড। এই কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২৫০০ টাকার আর্থিক সহায়তা অথবা সমপরিমাণ খাদ্যসামগ্রী, চাল, ডাল, লবণ, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির নিশ্চয়তা। দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নে এটি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে জনমনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

 

ঠিক একইভাবে, কৃষকদের জন্য তারেক রহমানের স্বপ্ন ফার্মার্স কার্ড, যেখানে কৃষকের পরিচয়, চাষাবাদের তথ্য, সুবিধা-অসুবিধা সবই নথিভুক্ত থাকবে। ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক সরবরাহ থেকে শুরু করে সরকারি ভর্তুকি, প্রণোদনা, ঋণ সুবিধা, কৃষিযন্ত্র ক্রয়, সেচ সহযোগিতা, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, আবহাওয়া তথ্য, কৃষি বিমা, প্রশিক্ষণ, সবকিছুই এই কার্ডের আওতায় আনা হবে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য এটি হবে একটি ডিজিটাল কৃষি বিপ্লব।

 

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি; বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ব্যাধি। তারেক রহমান এই দুর্নীতি নির্মূলে জোর দিয়েছেন সবার জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। বিএনপির পরিকল্পনায় রয়েছে এক লাখ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, যার ৮০ শতাংশই হবেন নারী। ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ সাধারণ রোগের ব্যাপক সচেতনতা, মা-শিশুর আলাদা স্বাস্থ্যসেবা, প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসায় পিপিপি সম্প্রসারণ, ঔষধ ও ভ্যাকসিন সরবরাহ নেটওয়ার্ক সুদৃঢ় করা, মশাবাহিত রোগ নির্মূলে বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ, সবই এই পরিকল্পনার অংশ। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এলে কেউ যেন চিকিৎসার অভাবে সর্বস্বান্ত না হয়, এ প্রতিশ্রুতিই তারেক রহমানের মূল দর্শন।

শিক্ষা খাতে তারেক রহমান ও বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ, সবার জন্য কারিগরি শিক্ষা, বাধ্যতামূলকভাবে তৃতীয় ভাষা শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মিড-ডে মিল’ চালু, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ‘ওয়ান টিচার, ওয়ান ট্যাব’ প্রকল্প, “লার্নিং উইথ হ্যাপিনেস” এসবই একটি আধুনিক, আনন্দমূলক ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই নেওয়া উদ্যোগ।

খেলাধুলাকেও বিএনপি জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখছে। ক্রীড়াকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া শিক্ষক নিয়োগ, চতুর্থ শ্রেণি থেকে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা, বিভাগীয় শহরে বিকেএসপি শাখা স্থাপন, ‘নতুন কুঁড়ি স্পোর্টস’ বৃত্তি, গ্রামে-গঞ্জে খেলার মাঠ, ৬৪ জেলায় ইনডোর সুবিধাসহ স্পোর্টস ভিলেজ, স্পেশাল চাহিদাসম্পন্নদের ক্রীড়া সুযোগ এবং দেশে ক্রীড়া সরঞ্জাম শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা বিএনপির। তারেক রহমানের বক্তব্য—“খেলাধুলা আর শুধু শখ নয়, আগামী প্রজন্মের প্রেরণা ও মর্যাদার পেশা” এই খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

নদী-খাল-বিল পুনরুদ্ধারেও রয়েছে যুগান্তকারী পরিকল্পনা। সারাদেশে ২০ হাজার কিলোমিটার নদী-খাল খনন- পুনঃখনন, তিস্তা ব্যারেজ উন্নয়ন, পদ্মা ব্যারেজ, ৫ বছরে ২৫ কোটি গাছ রোপণ, সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যার মাধ্যমে বর্জ্য থেকে জ্বালানি, জৈব সার, রিসাইক্লিং সুবিধা; এগুলো বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু স্থিতিশীলতায় ইতিহাস তৈরি করতে পারে।

ইমাম, মুয়াজ্জিন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তায় রয়েছে পৃথক পরিকল্পনা, মাসিক সম্মানী, উৎসব ভাতা, বিকল্প কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কর্মসূচির বিস্তৃতি এবং ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট। একই সঙ্গে অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের প্রধানদের জন্যও সমান সম্মানী ও ভাতার বিধান রাখা হয়েছে।

কর্মসংস্থানে তারেক রহমানের লক্ষ্য স্পষ্ট; ১৮ মাসে ১ কোটি কর্মসংস্থান। বিদেশে বছরে ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ভাষা প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, সবার জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থা করা, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও ক্যারিয়ার সেন্টার, মেধাভিত্তিক সরকারি নিয়োগ প্রদান, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান, বিশ্বের বড়ো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের হাব তৈরি করা, স্টার্ট-আপ ও উদ্ভাবন সহায়তা, রপ্তানি বৈচিত্র্য, “মেইড ইন বাংলাদেশ” পরিচিতি গড়ে তোলা, কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা, এসব পরিকল্পনা একটি গতিশীল ও আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তোলার ভিত্তি তৈরি করবে।

“সবার আগে বাংলাদেশ”—এই অঙ্গীকারকে ধারণ করে তারেক রহমান যে পরিকল্পনাগুলো সামনে এনেছেন, তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সত্যিই পরিণত হবে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারে সমৃদ্ধ এক নতুন রাষ্ট্রে।

 

লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক