Image description
 

সেদিন যে কেন হুট করে একটি জাতীয় দৈনিকের অফিসে গিয়েছিলাম, তা মনে হলে আজও হাসি পায়। হাসি যে শুধু আমারই পায় তা নয়—প্রকৃত ঘটনা শুনলে আপনিও না হেসে পারবেন না। নাটক-সিনেমা চেয়েও সাসপেন্সে ভরা সেই দিনটিতে হঠাৎ সেই পত্রিকা অফিসে আমাকে দেখে সম্পাদক মহোদয় যারপরনাই বিস্মিত ও অবাক হলেন। তারপর আমার উদ্দেশ্য জানতে পেরে একদফা হাসলেন এবং আমাকে নির্বাহী সম্পাদক সাহেবের রুমে বসতে দিয়ে বললেন—লিখুন।


আর আমি দুনিয়ার সব কিছু ভুলে লিখতে বসলাম সংশ্লিষ্ট পত্রিকার জন্য আমার সাপ্তাহিক নিবন্ধ।
আমি যেদিনের কথা বলছি সেদিন ছিল ২০১৩ সালের জুলাই মাসের ২৪ তারিখ। আগের রাতে অর্থাৎ ২৩ জুলাই রাতের বেলায় আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ভাই ফোন করে বললেন, তুমি আগামীকাল গ্রেপ্তার হচ্ছ। আমি বললাম, কেন।


জবাবে বলা হলো—নেত্রীর নির্দেশ। আমি চুপ হয়ে গেলাম। কারণ বিষয়টি আমি আগেই জানতাম। কিংবদন্তির আন্তর্জাতিক সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের তৎকালীন মালিক জনাব সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আমার বিরোধ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছিল।

টেলিভিশন মালিক সমিতি, সংবাদপত্র মালিক সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন ইত্যাদি জায়গাগুলোতে খালেদ মুহিউদ্দীনের মালিকের আধিপত্য ছিল চেঙ্গিস খান-হালাকু খানদের মতোই একচ্ছত্র। সুতরাং সেই বিপদের দিনেও দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ আমার পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তা এককথায় ছিল অভূতপূর্ব।

আজ এত দিন পর উল্লিখিত ঘটনার কথা কেন মনে পড়ল তা নিশ্চয়ই বলব, কিন্তু তার আগে নাটকীয় সেই দিনটির কথা বলে নিই। বিপদের দিনে মানুষের কিভাবে বুদ্ধি নাশ হয় এবং বন্ধুবেশে কিভাবে মানুষ সর্বনাশ করে তার জলজ্যান্ত কিছু ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল, যা স্মরণ হলে আজও ঘৃণায় শরীর রি রি করে ওঠে। যে রাতে অ্যাডভোকেট কামরুল ফোন দিলেন তার কিছুক্ষণ পরই সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ফোন দিলেন।


বিপু আমার বিশ্বস্ত বন্ধু কাম বড় ভাই। অন্ধের মতো ভালোবাসতাম এবং শ্রদ্ধা করতাম। বিপু জিজ্ঞেস করলেন—এখন কী করবা। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম—আমার জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন। বিপু বলল, আমি পদত্যাগ করতাম। বিপু যে সালমানের এজেন্ট হয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য ফোন দিয়েছেন তা আমার মাথায় এলো না। বরং সে যে পরামর্শ দিল তা আমি অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে গোগ্রাসে গিললাম এবং ফেসবুকে পদত্যাগের ঘোষণা দিলাম।
সারা রাত মনের আনন্দে বেঘোরে ঘুমালাম। ভাবলাম—বিপু গংরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন এবং তাঁকে বোঝাবেন যে রনি পদত্যাগ করলে সর্বনাশ হবে আর প্রধানমন্ত্রী বিপুর কথায় তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। সকালে বিপুর সঙ্গে আরেক দফা কথা হলো এবং তাঁকে বিশ্বাস করে পদত্যাগ করার জন্য স্পিকার শিরীন শারমিনের অফিসে হাজির হলাম। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান আ স ম ফিরোজ সেখানে ছিলেন এবং সব কিছু শুনে তিনি বললেন, ভুলেও পদত্যাগ  কোরো না। আগে জেনে নাও, তারপর জেল থেকে বের হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও। ফিরোজ ভাইয়ের কথায় আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। কিন্তু এরই মধ্যে বিপু-সালমান গংরা আমার পদত্যাগ পর্ব লাইফ টেলিকাস্ট করার জন্য সব টেলিভিশনের গাড়ি সংসদ ভবনে পাঠিয়েছেন। আমি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলাম এবং সব টেলিভিশনের লাইভ টেলিকাস্টের সুযোগ পেয়ে সালমান গংদের কুকর্ম যথাসম্ভব বলতে আরম্ভ করলাম এবং সবশেষে বললাম, স্পিকারের অনুরোধে আমি আপাতত পদত্যাগ করছি না।

বিপু গংয়ের প্রথম চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁরা দ্বিতীয় চক্রান্ত শুরু করলেন। ডিজিএফআই অফিস থেকে জনৈক ব্রিগেডিয়ার সিকদার ফোন করে বললেন—‘স্যার! আমরা চেষ্টা করছি সমস্যাটির সমাধান করার জন্য। আপনি যদি দয়া করে একটু আমাদের কচুক্ষেতের অফিসে আসেন, তবে ভালো হয়।’ আমি সেখানে গেলাম। কারণ ডিজিএফআইকে বিশ্বাস করার কিছু কারণ ছিল। আমি এমনিতেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ধড়িবাজ, দুর্নীতিবাজ লোকজন থেকে দূরে থাকি। সে ক্ষেত্রে ডিজিএফআইকে আমি সবচেয়ে ভয়ংকর মনে করতাম। অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্ট সম্পর্কে আমার এক ধরনের ভয় থাকার কারণে পারতপক্ষে কোনো সামরিক কর্তার ধারেকাছেও জীবনে যাইনি। এই অবস্থায় হঠাৎ আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ২০১০ সালে ফোন করে জানাল যে সে ডিজিএফআইয়ে কর্নেল পদে কর্মরত। পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু নিয়ে ডিজিএফআইয়ের শীর্ষ কর্তারা আমার সাহায্য আশা করছেন।

আমি সম্মতি দিলে কর্নেল বন্ধুটি তাঁর সিনিয়র কর্তাদের নিয়ে কয়েক দফা আমার অফিসে এলেন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আমি পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা নিয়ে মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে অনেক দিন কথা বললাম। সেই সূত্রে যখন ডিজিএফআই থেকে আমার সংকটকালে ফোন এলো তখন মনে হলো দুনিয়ায় এখনো ভালো মানুষ আছে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার সিকদার এবং ডিজিএফআইয়ের ডিজি আকবর আমার সঙ্গে সেদিন যে প্রতারণা করলেন তার বিচার নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁরা পেয়ে গেছেন। সুতরাং সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু এতটুকু বলছি যে সেদিন খোশগল্পের নামে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় আমাকে ডিজিএফআই অফিসে বসিয়ে রেখে ঢাকা সিএমএম কোর্টে আমার জামিন বাতিল এবং নতুন ওয়ারেন্ট ইস্যুর বিষয়টি যেভাবে করা হয়েছিল, তা যখন আমি বুঝতে পারি তখন যে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলাম সেই দীর্ঘশ্বাসের পরিণতি এত নির্মম হবে তা ২০২৫ সাল না হলে বুঝতেই পারতাম না।

ডিজিএফআই অফিস থেকে যখন বের হলাম তখন আমি নিশ্চিত হলাম যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে। জীবনের সেই ক্রান্তিকালে আমার অন্য কোনো কথা স্মরণে এলো না। শুধু মনে পড়ল একটি দৈনিকে আমি যে নিয়মিত লেখালেখি করি সেই পত্রিকার পাঠকদের কথা। প্রতি সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাটিতে আমার লিখিত উপসম্পাদকীয় নিয়মিত ছাপা হতো দীর্ঘদিন ধরে এবং তা প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের ফোন, প্রতিক্রিয়া, আগ্রহ ইত্যাদি আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখত। কাজেই জেলে যাওয়ার আগে যদি অন্তত দু-তিনটি পর্ব লিখে যেতে পারি সে জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সোজা পত্রিকা অফিসটিতে পৌঁছালাম।

আমি যখন লিখছিলাম তখন সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকসহ অন্য সিনিয়র সাংবাদিকরা বারবার উঁকি দিচ্ছিলেন। এক সাংবাদিক তো বলেই ফেললেন, ভারি অদ্ভুত মানুষ তো আপনি, কোর্টে আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়ে গেছে, ডিবি পুলিশ আশপাশের এলাকায় গিজগিজ করছে আপনাকে গ্রেপ্তারের জন্য, আর আপনি রাজনীতির প্রেমকাহিনি লিখছেন। ওই সাংবাদিক যখন মসকরা করছিলেন তখন হঠাৎ পত্রিকার সম্পাদক সাহেব গর্জে উঠলেন। কাউকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনারা কারা। এখানে কেন ঢুকেছেন। একটা পত্রিকা অফিসে ঢোকার সাহস পেলেন কোত্থেকে। গেট আউট—অফিস থেকে বের হন এবং অফিসের সামনেও দাঁড়াবেন না। দূরে গিয়ে অপেক্ষা করেন। সময় হলে আমরাই এমপি সাহেবকে আপনাদের  কাছে হস্তান্তর করব।’

উল্লিখিত ঘটনার পর সম্পাদক সাহেব আমার কাছে এলেন এবং বললেন, ওরা বাইরে অপেক্ষা করছে। আপনি যতটুকু লিখেছেন তাতেই হবে। বরং আজকের দিনের অনুভূতি ও গ্রেপ্তার প্রসঙ্গ নিয়ে সংক্ষেপে কিছু লিখুন, যা আমাদের পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হবে। আমি চলমান, প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে রোবটের মতো সম্পাদকের পরামর্শে আমার অনুভূতি লিখতে বসলাম এবং পনেরো মিনিট বাদে তা সম্পাদকের হাতে দিয়ে গ্রেপ্তার বরণের জন্য রওনা দিলাম। রাস্তায় তখন উত্সুক জনতার ভিড়। মিডিয়া হাউসটির কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বয়ং সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে মূল সড়কে এলেন। সম্পাদক ডিবি কর্তা, টেলিভিশন ক্যামেরাম্যান ও সাংবাদিকদের বললেন আরো দূরে সরে যাওয়ার জন্য এবং তাঁরা পত্রিকা অফিস থেকে কয়েক শ গজ দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন।

আমি ডিবির গাড়িতে উঠার আগে সম্পাদক সাহেব এবং তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কোলাকুলি করলাম। তাঁরা দাঁড়িয়ে থেকে হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানালেন এবং যতক্ষণ আমাদের গাড়িবহর দৃষ্টিসীমার মধ্যে রইল ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আজ এত বছর পর মবের রাজ্যে বসে ফ্যাসিবাদী জামানার একজন সম্পাদকের মেরুদণ্ড— সংবাদপত্রের মর্যাদা এবং একজন লেখকের যে রসায়ন ছিল তা মনে হতেই এক ধরনের নস্টালজিয়া তৈরি হয়ে যায় এবং নতুন বন্দোবস্তের নতুন স্লোগান—টিনের চালে কাউয়া/এক দুই তিন চার এর কথা স্মরণ হলে মন মস্তিষ্কের আতঙ্ক শরীরের মধ্য প্রদেশের বিশেষ অঙ্গে কম্পন ধরিয়ে দেয়।

 

লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক