Image description
আলফাজ আনাম

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে পলাতক হাসিনা ও তার সহযোগীরা। এই পরিকল্পনায় দিল্লির যে সক্রিয় সমর্থন আছে, তাও স্পষ্ট। গত বছরের ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন নীরব ছিলেন হাসিনা। তিনি কোথায়, কীভাবে অবস্থান করছেন তা গোপন রেখেছে তার আশ্রয়দাতা ভারত সরকার। কয়েক মাস নিশ্চুপ থাকার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসিনার অডিও বক্তব্য প্রচার করে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন পলাতক আওয়ামী নেতারা। কিন্তু তাতে খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং কর্মী-সমর্থকদের ফেলে রেখে এমপি, মন্ত্রীসহ পলায়ন হাসিনার নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

হত্যা, গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য হাসিনার বিচারের সময় ঘনিয়ে আসছে। বিচারের তারিখ ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আবার পুরোনো চেহারা নিয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। রাজধানীসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায় সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন নিষিদ্ধ দলটির নেতাকর্মীরা। বেশ কিছু যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় রাতে বাসে আগুন দিয়ে ঘুমন্ত এক বাসচালককে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।

আওয়ামী রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগ্নিসন্ত্রাস। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালে ৫ জুন সারা দেশে ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছিল আওয়ামী লীগ। তার আগের দিন সন্ধ্যায় শেরাটন হোটেলের সামনে দোতলা বিআরটিসির বাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে শিশুসহ ১১ জন মারা যায়। ওয়ান-ইলেভেনের পর তৎকালীন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল করিম সেলিম জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমের পরিকল্পনায় বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য এ দুই নেতাকে দায়ী করেন। শেখ হাসিনা এই অগ্নিসন্ত্রাসীদের পুরস্কার হিসেবে মন্ত্রী করেছিলেন। সন্ত্রাসী রাজনীতির গডফাদার হিসেবে পরিচিত এই তিন আওয়ামী নেতা এখন ভারতে পালিয়ে আছেন।

২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের সময় এবং পরে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো যখন আন্দোলন জোরদার করেছে, তখনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বেশ কয়েকবার ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। এসব অগ্নিকাণ্ডে এমন সব দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হতো, যা সাধারণ বিক্ষোভকারীদের হাতে আসা ছিল অসম্ভব। বাস ও ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার পর বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হতো। শেখ হাসিনার দেড় দশকের নিপীড়নমূলক শাসনে হাজার হাজার মানুষকে এসব মামলায় আসামি করে জেলে পোরা হয়েছে। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে এ ধরনের গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আসামি করা হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সে সময় বারবার অভিযোগ করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গাড়িতে আগুন ধরিয়ে মানুষ হত্যা করেছে এবং তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দল দমনের এটি ছিল শেখ হাসিনার একটি বড় অস্ত্র।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় যেভাবে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে বিক্ষোভকারী ছাত্র ও শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে এখন স্পষ্ট আওয়ামী শাসনে দেড় দশকে অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ কীভাবে জড়িত ছিল। এখন পলাতক আওয়ামী লীগ সেই হত্যার পুরোনো পথ বেছে নিয়েছে।

শেখ হাসিনার বিচার ও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এখন শেখ হাসিনার প্রধান লক্ষ্য। এর মধ্যে ভারত সরকারের সহযোগিতায় পিআর ফার্মের মাধ্যমে কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হাসিনার কিছু বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। যেখানে তিনি তার অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। বিশ্বে তিনি একজন স্বীকৃত খুনি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তিনি খুনের দায় অস্বীকার করছেন।

মজার ব্যাপার হলোÑসাক্ষাৎকার প্রচার করা সবগুলো গণমাধ্যম বলছে, পলাতক হাসিনার এটি প্রথম সাক্ষাৎকার। কিন্তু তিনি সব সাক্ষাৎকারে একই ভাষায় ও একই সুরে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়েছে ইমেইলে। শেখ হাসিনা সম্ভবত মানসিকভাবে এখনো সুস্থির হতে না পারায় ক্যামেরার সামনে বা প্রকাশ্যে আসার সাহস দেখাতে পারছেন না। এসব সাক্ষাৎকার প্রচার করে হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তারা রাজনৈতিক উপযোগিতা দেখানোর চেষ্টা করলেও অভ্যুত্থানের সময় মানুষ হত্যা করার নিষ্ঠুর পরিকল্পনার বিষয়গুলো আবার সামনে এসেছে।

এসব সাক্ষাৎকারে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দায় হাসিনা অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। তিনি খুব স্পষ্টভাবে এসব হত্যাকাণ্ডের দায় চাপিয়েছেন পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। অথচ বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভকারীদের লেথাল উইপন বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার টেলিফোনে দেওয়া নির্দেশ ফাঁস হয়েছে। এসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যার মধ্যে ১২-১৩ শতাংশই ছিল শিশু। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৩৩ শিশু-কিশোর শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিশুশ্রমিক রয়েছে। শেখ হাসিনার নামে প্রকাশ হওয়া এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষাৎকার বা বক্তব্যে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। জাতির কাছে তার নির্মমতার জন্য ক্ষমা চাননি।

দিল্লি থেকে শেখ হাসিনার নামে দেওয়া এসব সাক্ষাৎকার যে ভারত সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে করা হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল, দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতার স্বার্থে হাসিনা যেন তার মুখ বন্ধ রাখেন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার এই আহ্বান ভারত সরকার তো আমলে নেয়নি; বরং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি ভারতের একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসকে কথাবার্তায় সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনাথ সিংয়ের এ ধরনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নির্দেশে যে অগ্নিসন্ত্রাস চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোর পেছনে ভারতের সমর্থন রয়েছে। পলাতক আওয়ামী নেতারা কলকাতায় বসে তার সমর্থকদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।

বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ভারতের এই ভূমিকা নতুন নয়। মুজিবের একদলীয় শাসনের পতনের পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আওয়ামী সন্ত্রাসবাদীরা ভারতে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। জিয়াউর রহমানের সরকার তাদের কঠোরভাবে দমন করেছিলেন। সেই কাদের সিদ্দিকী এখন আবার দেশের ভেতরে তৎপর হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি তিনি বলছেন, ১৪ দল ছাড়া নাকি তিনি নির্বাচনে যাবেন না। বোঝা যাচ্ছে, ভারত তার সব শক্তি মাঠে নামিয়েছে।

হাসিনার দেড় দশকের শাসনে গুম, খুন ও গণতন্ত্র হত্যার সঙ্গে ভারত সরাসরি জড়িত ছিল। বাংলাদেশ থেকে গুম হওয়া সুখরঞ্জন বালি ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে ভারতে পাওয়া গিয়েছিল। এ দুটি ঘটনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়, ভারত কীভাবে এ দেশের গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি গুম কমিশনের ডকুমেন্টারিতে এ ধরনের আরো কয়েকটি ঘটনার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া গণতন্ত্র হত্যা ও নির্বাচন কলুষিত করার বহু উদাহরণের মধ্যে একটি হলো ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সুজাতা সিংয়ের ঢাকা আগমন।

বাংলাদেশ যখন দেড় দশক পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দিল্লিতে থাকা হাসিনাকে আবার সক্রিয় করেছে ভারত। লুটের অর্থ খরচ করে একদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থের বিনিময়ে নিষিদ্ধ নেতাকর্মী ও সমাজবিরোধী অপরাধীদের মাধ্যমে দেশে অগ্নিসংযোগ এবং বোমাবাজির মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের কৌশল নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ হাসিনার বোমাবাজি বা অগ্নিসন্ত্রাসে ভীত হবেÑএমনটা ভাবার কারণ নেই। কারণ দেশের মানুষ তাদের শুধু পরাজিত করেনি, দেশছাড়া করতে বাধ্য করেছে।

নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অগ্নিসন্ত্রাসের এই সাহস পেত না যদি রাজনৈতিক নেতারা ঐক্যবদ্ধ থাকতেন। আওয়ামী লীগের ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোটের আশায় এই রাজনৈতিক নেতারা এখন সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাকর্মীদের কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত মামলা আছে, সব তুলে নেওয়া হবে। তার এই বক্তব্যের ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পরে অবশ্য বলেছেন, তিনি সব মামলা তুলে নেওয়ার কথা বলেননি। দেড় দশকে আওয়ামী লীগের অত্যাচারের শিকার বিএনপি নেতাকর্মীরা স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মামলার বাদী। মির্জা ফখরুলের উচিত এসব মামলা তুলে নেওয়ার আগে তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তিনি এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও নিপীড়কদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। এর আগে জামায়াতের আমিরও সবাইকে মাফ করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যেও চলছে কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায় তা নিয়ে দলের মধ্যে কামড়াকামড়ি। রাজনৈতিক দলের নেতারা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তাহলে বিদেশি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসের পথ ধরে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করবে। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে আরো নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনের পথ তৈরি হবে।