বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া একটি সময়ের প্রতীক। তিনি শুধু দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীই নন, বরং এমন এক নেতা, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতিতে নারীর নেতৃত্বের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে যখন বিএনপির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে, তখন খালেদা জিয়া নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা তখনো সীমিত। কিন্তু তিনি দ্রুতই প্রমাণ করেন, নেতৃত্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে দৃঢ়তা ও সাহসের বিষয়। অল্প সময়ের মধ্যেই বিএনপিকে সংগঠিত করে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৮০-এর দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে নয় বছর তিনি রাজপথে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। বারবার গৃহবন্দি, গ্রেপ্তার ও দমননীতি তাকে থামাতে পারেনি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার নেতৃত্বেই দেশের রাজনীতিতে নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেই সময় থেকেই তিনি ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মতো পদক্ষেপ তার সময়েই নেওয়া হয়। রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের স্বীকৃতিও বেড়ে যায়।
তবে তার রাজনৈতিক পথ কখনো সহজ ছিল না। এরশাদের সময়ের মতোই ‘ওয়ান ইলেভেন’ পর্বে এবং পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে তাকে কারাবন্দি হতে হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতা ও রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি মাঠ ছাড়েননি। দলের নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন দৃঢ়ভাবে। বিএনপির ভেতরে এখনো তাকে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকলে যে সম্মান, তা কেবল পদমর্যাদা নয়, আবেগেরও প্রতিফলন।
খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আলাদা করে তুলেছে তার নেতৃত্বের ধরন। তিনি কম কথা বলেন, কিন্তু অবস্থানে সুদৃঢ়। দলীয় সিদ্ধান্তে ধৈর্য দেখিয়েছেন, কর্মীদের প্রতি রেখেছেন আস্থা। তার রাজনীতি মূলত গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অধিকার রক্ষার আদর্শে গঠিত।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রতিবারই চ্যালেঞ্জ ছিল আলাদা- অর্থনীতি, প্রশাসন, কিংবা দলীয় স্থিতিশীলতা। সবসময় তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের মতো করে, কোনো বহিরাগত পরামর্শে নয়। রাজনীতিতে তার এই স্বাধীনতা ও স্থিরতা তাকে আলাদা করে তুলেছে। তার সমর্থকরা তাকে সৎ ও নৈতিক রাজনীতির প্রতীক মনে করেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিতর্কে জড়াননি। তার জীবনযাপন ছিল সংযমী, দলনির্ভর এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্কভিত্তিক। রাজনীতির এই ব্যক্তিগত সততা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরল।
বর্তমান সময়ে বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ ও রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও বিএনপি তার নামেই সংগঠিত। দলের প্রতিটি আন্দোলন বা কর্মসূচিতে তার নেতৃত্বের স্মারক রয়ে গেছে। এটি প্রমাণ করে, তিনি কেবল একজন নেতা নন, একটি রাজনৈতিক ধারা ও মানসিকতার প্রতীক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া আলাদা- কারণ তিনি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের ধারাকে ধরে রেখেছেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তার রাজনৈতিক জীবনে ছিল সংগ্রাম, ক্ষমতা, কারাবাস এবং আত্মত্যাগ- সবকিছু মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি। রাজনীতিতে ক্ষমতা পরিবর্তন হতে পারে, নেতা বদলাতে পারে, কিন্তু খালেদা জিয়া নামটি থাকবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায় হিসেবে- দৃঢ়তা, সহিষ্ণুতা ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে।
লেখক : প্রকাশক ও কলাম লেখক
সাঈদ বারী