
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
জাতীয় সনদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
‘জাতীয় সনদ ২০২৫’ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলিল নয়—এটি এক গণতান্ত্রিক জাতির নৈতিক পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি। বহু দশকের শাসনব্যবস্থার অবক্ষয়, জনগণের প্রত্যয়হীনতা, ফ্যাসিবাদী হস্তক্ষেপ ও বিচারহীনতার বিপরীতে এই সনদ একটি ঐতিহাসিক পালাবদলের ঘোষণা। এটি ১৯৫২, ১৯৭১ ও ২০২৪-এর গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জনগণের সংগ্রামী অভিপ্রায়কে সাংবিধানিক ভাষায় রূপান্তর করে। এই সনদ যেমন অতীতের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানায়, তেমনি ভবিষ্যতের রাষ্ট্র বিনির্মাণে দিকনির্দেশনা দেয়। তাই এই সনদ কেবল আইন বা নীতির সংকলন নয়—এটি জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের এক নতুন চুক্তিপত্র, যেখানে মানবিকমর্যাদা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারকে রক্ষা করা হবে রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে।
স্মরণ করা প্রয়োজন, জুলাই ২০২৪-এর আগুনঝরা দিনগুলোতে ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্দেশে যে-নিষ্ঠুর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে—তা ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়। সহস্র পরিবার আজ সন্তানহারা। শিশুরা ফিরে পায়নি বাবাকে, অনেকেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা আর নির্যাতনের যে-নির্মমতা চালানো হয়েছে—তার চিহ্ন আজো লেগে আছে মাটিতে, দেয়ালে, জনতার কান্নায়।
‘জুলাই জাতীয় সনদ’ এই নৃশংসতার মুখে চুপ থাকার রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে। আমরা অঙ্গীকার করি—এই গণহত্যার পূর্ণ তদন্ত, অপরাধীদের বিচার আর প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ন্যায় ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কারণ, ন্যায় ছাড়া কোনো নতুন রাষ্ট্র গড়া যায় না।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্যের বহুমুখী চেষ্টার ফল। এই সনদে কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত হলেও বাস্তবায়ন ও সামাজিক প্রকৃতির নানা সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে পর্যালোচনা জরুরি। যদিও কোনো সনদ, সংবিধান বা ঘোষণাপত্র কোনোটাই নিরঙ্কুশ করা সম্ভব নয়, তবু এর মূল্যায়ন হয় তার নৈতিক প্রতিশ্রুতির দৃষ্টিকোণ থেকে, যা সমগ্র জাতির অন্তর্দৃষ্টি ও সংগ্রামের প্রতিফলন বহন করে।
সনদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা:
১. সনদে মূলত কাঠামোগত ও আইনগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেও রাষ্ট্র এবং সমাজের নৈতিক পুনর্গঠন ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই।
২. অর্থনৈতিক ন্যায় এবং সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিয়ে যথাযথ মনোযোগের অভাব দেখা যায়।
৩. জনগণের বা বিকশিত সমাজশক্তির অংশগ্রহণ ও মতামত সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে।
৪. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অস্বচ্ছতা ও স্বার্থান্বেষণের কারণে সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে।
৫. সংস্কারের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও তদারকির জন্য কার্যকর কোনো কাঠামো সনদে উল্লেখ নেই, যা টেকসই বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামগ্রিক চ্যালেঞ্জসমূহ:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বৈরাচারী মনোভাবের গভীর শেকড়, ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ ও বিরোধীদের দমনমূলক অবস্থান, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিস্তার—এসব চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রযন্ত্রের জড়তা ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধ, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও দমননীতির সংস্কৃতি, সামরিক হস্তক্ষেপ ও অগণতান্ত্রিক প্রভুত্বের উত্তরাধিকার, ধর্ম, জাতিসত্তা ও শ্রেণি বৈষম্যজনিত বিভাজন, বহির্বিশ্বের চাপ ও বৈশ্বিক পুঁজিবাদী প্রভাব, শিক্ষা ও নৈতিক চর্চার সংকট—এসবই এই প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে নৈতিক প্রজাতন্ত্র ছাড়া রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা সম্ভব নয়।
নৈতিকতা ছাড়া সংস্কার অসম্ভব:
রাষ্ট্রের সংস্কার কেবলমাত্র আইনি কাঠামো বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ রাখলে তা আত্মাবিহীন এক যান্ত্রিক রূপ পায়। একটি রাষ্ট্র যখন নৈতিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন সেই সংকট কেবল সংবিধানের ধারা পরিবর্তন বা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরসন সম্ভব নয়।
‘জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাই কেবল রাজনৈতিক ঐকমত্যে নয়, নৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো। রাষ্ট্র এবং নাগরিক—উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ব, মূল্যবোধ ও আস্থার যে সম্পর্ক সেটিকে পুনঃস্থাপন না করলে কোনো সংস্কার কার্যকর হবে না।
এই জন্য ‘জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ নৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারপত্র সংযোজন একান্ত অপরিহার্য, যা জনগণের প্রতি—রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের সম্মান ও আনুগত্যকে একটি নৈতিক ভিত্তিতে স্থাপন করবে। এই নৈতিক ভিত্তি ছাড়া জাতীয় সনদ হবে শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক চুক্তিপত্র।
জাতীয় সনদ ২০২৫ সংশোধনের প্রস্তাবনা:
১) নৈতিক প্রজাতন্ত্রের রূপরেখা:
রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এই সংকটময় সময়ে প্রয়োজন একটি ‘নৈতিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা। যেখানে শুধু ক্ষমতা ও আইন নয়, নৈতিকতা ও ‘মানবিকমর্যাদা’ হবে শাসনের মূলভিত্তি।
নৈতিক প্রজাতন্ত্রের মূল দিকসমূহ হলো—
মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদা ও সাম্যের প্রতি অঙ্গীকার; সততা, দায়িত্ববোধ ও জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; জনগণের অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের বাইরে সমাজশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মতামত গ্রহণের সর্বোচ্চ গুরুত্ব; সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা; শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ; আইন ও নৈতিকতার সমন্বয়।
২) নৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারপত্র:
জাতীয় সনদের এই অধ্যায়ে আমরা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য নিম্নলিখিত প্রতিশ্রুতিগুলো উচ্চারণ করছি—
১. গণতন্ত্র (Democracy):
রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। অর্থাৎ, Democracy is a Government of the People, by the People and for the People. নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছাই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র বৈধ উৎস।
২. জীবন (Life):
রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে জনগণের জীবন সুরক্ষাকে। নাগরিকের জীবনকে অগ্রাহ্য করে কোনো উন্নয়ন, কর্তৃত্ব বা নিরাপত্তা গ্রহণযোগ্য নয়। Life First, Always.
৩. সম্প্রীতি (Harmony):
সকল ধর্ম, মত ও জাতিসত্তার মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য রাষ্ট্র হবে পক্ষপাতহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা হবে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
৪. প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা (Commitment):
স্বৈরাচার, সামরিক দখলদারিত্ব বা একদলীয় কর্তৃত্ববাদে রাষ্ট্র আর কখনো ফিরে যাবে না। রাষ্ট্র থাকবে গণতন্ত্র, সমতা ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
৫. দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা (Determination):
রাষ্ট্র পরিচালিত হবে শুধুমাত্র জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে। কোনো বর্হিশক্তি, সামরিক গোষ্ঠী বা অলিখিত প্রভুত্ব—রাষ্ট্র পরিচালনার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
৬. জাতীয় ঐক্য (National Consensus):
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার মূলভিত্তি হবে জাতীয় ঐক্য। জাতীয়তাবাদ হবে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক—যা সকল জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে।
৭. নির্দেশনা (Guiding Philosophy):
রাষ্ট্র পরিচালিত হবে তিনটি নৈতিক স্তম্ভে—সাম্য, মানবিকমর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান—এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনা হবে রাষ্ট্রচিন্তার মূল দিকনির্দেশনা।
৮. মানবিক মর্যাদা (Human Dignity):
মানবিকমর্যাদা হবে রাষ্ট্রের সকল আইন, নীতি ও কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে না, বরং তা সংরক্ষণ ও বিকাশে নিজেকে উৎসর্গ করবে। The State Exists to Defend Human Dignity.
৯. আন্তর্জাতিক দায়িত্ব (Global Responsibility):
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয়মুক্তি ও মানবিক ন্যায়বিচারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি এবং সহযোগিতার পক্ষে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ হবে মুক্তিকামী মানবজাতির সংগ্রামের এক গর্বিত অংশীদার।
১০. গণ-অভিপ্রায়ের উত্তরাধিকার (Legacy of Popular Will):
এই সনদ হবে '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, রক্তঝরা মার্চ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের গণ-আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত প্রকাশ। এটি কোনো শাসকগোষ্ঠীর মালিকানাধীন দলিল নয়, এটি হবে জনগণের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
১১. বিদ্রোহের অধিকার (Right to Resist):
কোনো গোষ্ঠী যদি এই সংবিধানকে ক্ষমতার খেলনা বানায় অথবা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে রাষ্ট্র দখল করে—তবে সেই রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে গণ-বিদ্রোহ হবে জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার।
১২. প্রজাতন্ত্র দিবস (Republic Day):
দশ (১০) এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হিসেবে জাতীয়ভাবে উদযাপন করা হবে।
এইসকল প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে ‘নৈতিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার অমোঘ সংকল্প ঘোষণা করছি। 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ উক্ত সংশোধনসমূহ অন্তর্ভুক্ত করলে এটি কৌশলগত দলিল থেকে রূপান্তরিত হবে একটি নৈতিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞানপত্রে, যা ভবিষ্যতের রাষ্ট্রগঠনের মর্মবাণী বহন করবে। কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি নৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠন ছাড়া এ পথ অসম্পূর্ণ থাকবে। আমরা নৈতিক প্রজাতন্ত্রের আদর্শকে জাতীয় প্রথা ও নীতিতে রূপান্তরিত করে এক মুক্ত, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বাধ্য। এটাই আমাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব, যার সফল বাস্তবায়নে সকল শ্রেণি, পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক দল একত্রে কাজ করবে। এই মূল্যবোধের অবিচল ধারায় বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের মানুষের মর্যাদা রক্ষাকারী, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী এবং গণতন্ত্রের এক উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলক।
লেখক: গীতকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক