Image description

অলিউল্লাহ নোমান

ছোটবেলা থেকেই গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের লড়াইয়ের কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। ১৯৮২ সালে এরশাদ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন আমি কিশোর। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি। এরশাদ বিদায় নেওয়ার সময় টগবগে তরুণ। তখনো ছাত্র। এরশাদ বিদায় নেওয়ার আগে দুটি জাতীয় নির্বাচন দেখেছি। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে নিজের চোখে দেখেছি কীভাবে জালভোট দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে ভোট চুরি এবং ফলাফল পাল্টে দেওয়ার ঘটনা পাঠ করেছি পুস্তকে। মোটকথা, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া শুরু হয়েছিল শেখ মুজিবের হাত দিয়ে।

১৯৮৬ ও ’৮৮ সালের নির্বাচনে এরশাদের প্রার্থীর পক্ষে জয়জয়কার। তখন তো সোশ্যাল মিডিয়া বলতে কিছুই ছিল না। বেসরকারি রেডিও ও টেলিভিশনও ছিল না। সংবাদপত্র ছিল খবরের ভরসা। বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার রাতের সংবাদ মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন ঘটেছিল। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ছাত্রসংগঠনগুলোর সংগ্রাম পরিষদ গঠন, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর জোটের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় ছিল। ৯ বছরের সম্মিলিত লড়াই-সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে—এমন একটি মুহূর্তে সেনাবাহিনী এরশাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য এরশাদকে জানিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নূর উদ্দিনের পক্ষ থেকে। এর পরই এরশাদ পদত্যাগ করেন। তবে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের নামে এরশাদ শেখ হাসিনার মতো মানুষ খুন করেননি। এরশাদের ৯ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে ১০ জনও খুন হয়নি। এই খুনের জন্য এরশাদকে খুনি ও বিশ্ববেহায়া হিসেবে খেতাবও দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ নূর হোসেন, জিহাদ ও ডা. মিলন হত্যার ঘটনায় চূড়ান্ত পতন হয় এরশাদের। নূর হোসেন ও জিহাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু ডা. মিলন কার গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, তা এখনো অস্পষ্ট। এরশাদ পতনের পর মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়।

এক.

এরশাদের পদত্যাগের সিদ্ধান্তের পর প্রশ্ন উঠেছিল—তিনি কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন? তৎকালীন সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান ছিল। কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টির কারো প্রতি তখন আস্থা নেই। সব দল মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সর্বজনের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি। সাহাবুদ্দীন আহমদ তখন প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। তাকে অনুরোধ জানানো হলো দায়িত্ব নিতে। তিনি শর্ত দিলেন, নির্বাচনের পর আবার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে আসার সুযোগ রাখতে হবে। এজন্য সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। তার অভিপ্রায়ে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মতি দিলে তিনি রাজি হন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তখন উপরাষ্ট্রপতি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দিলেন। তারপর উপরাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিলেন এরশাদ। এরশাদের পদত্যাগের সিদ্ধান্তের পর একটি সমঝোতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এরশাদকে গ্রেপ্তার করা, বাসায় তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করা ও মামলা দেওয়া—এসব ভিন্ন ঘটনা। এসব নিয়ে আজকের আলোচনা নয়, আজকের আলোচনা সুষ্ঠু নির্বাচন।

বিচার সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত ১০ সদস্যের সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সরকারের দশজনের একজন ছিলেন বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখনো উপদেষ্টা ছিলেন মাত্র ১০ জন। সুতরাং সুষ্ঠু নির্বাচন তদারকিতে তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত।

দেশে-বিদেশে সর্বমহলে প্রশংসিত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর সবাই ভাবছিলেন, দেশে ভোট নিয়ে আর কোনোদিন ছিনিমিনি খেলার সুযোগ থাকবে না। একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দেশে ভবিষ্যতে সুন্দর নির্বাচন হবে এবং ধীরে ধীরে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করবে। কিন্তু মানুষের এই ভাবনা ও স্বপ্ন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

দুই.

১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রথমে ১৩৮ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বিএনপি। কিন্তু সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৫১ আসনের সমর্থন। ভোটের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি ভাষণে বললেন, এখনই কাউকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারছেন না, কারণ সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কারো নেই। পরের দিনই জামায়াতে ইসলামীর একটি প্রতিনিধিদল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করল। ১৮ সিটে বিজয়ী জামায়াতে ইসলামী নিঃশর্ত সমর্থন জানাল বিএনপির প্রতি। এর পরই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আমন্ত্রণ পান।

বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হয় ভোট নিয়ে। মাগুরায় একটি উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও শুরু হয় ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও কম হয়নি। বিএনপিকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়া জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দেয়। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি তখন এক কাতারে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। কথিত সুশীলরাও এই দাবির পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে জনমত তৈরিতে নিরন্তর চেষ্টা চালায়। রাজনৈতিক দলগুলো যুগপৎ কর্মসূচি দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। সংসদ থেকে সব বিরোধী দল একযোগে পদত্যাগ করল। তখন এনডিপির একমাত্র সিটে বিজয়ী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলই সংসদে থাকেনি। পাশাপাশি চলল জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি। হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ—সবই হয়েছে তখন। ১৭৩ দিনের হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগে রাষ্ট্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একপর্যায়ে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তৎকালীন বিএনপি সরকার। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্ত করে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হলো। এই সংশোধনীর পরপরই পদত্যাগ করল বেগম খালেদা জিয়ার সরকার।

তিন.

দেশের ইতিহাসে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়েও মানুষের মাঝে কোনো প্রশ্ন নেই। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশি আসন লাভ করে। তবে এককভাবে সরকার গঠনের সুযোগ ছিল না। জাতীয় পার্টি এবং আ স ম আবদুর রবের জাসদকে নিয়ে তথাকথিত ঐকমত্যের সরকার গঠন করে দলটি। নানা ইস্যুতে আবারও হরতাল-অবরোধ। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হলো। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, গডফাদার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চারদলীয় জোট গঠন করা হলো। যেহেতু সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল, তাই শেখ হাসিনা ২০০১ সালের জুলাই মাসে মেয়াদ শেষে বিদায় নিলেন। সে বছরের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শেখ হাসিনার সাজানো নির্বাচন কমিশন, সাজানো প্রশাসন ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ভোটে চারদলীয় জোট বিশাল জয়লাভ করে। পরের দিন অনেক পত্রিকায় শিরোনাম ছিল ‘নীরব ভোট বিপ্লব’। এই ভোট বিপ্লবের সরকার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী সরকার।

চার.

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারও জ্বালাও-পোড়াও অসহযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা; দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করে তখন। চারদলীয় জোট সরকার সাজানো প্রশাসন, সেনা প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন রেখে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর মেয়াদ শেষ করে। সেদিনই জঙ্গি রূপ ধারণ করে লগি-বৈঠার সন্ত্রাসে মেতে ওঠে আওয়ামী লীগ। রাজপথে প্রকাশ্যে পিটিয়ে প্রতিপক্ষের কর্মীদের হত্যার দৃশ্য অবাক করে পৃথিবীকে। তারপরও শেখ হাসিনার বিচার দাবিতে কোনো কর্মসূচি ছিল না। নির্বাচনের পথে ব্যর্থ ছিল বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোট।

শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কারের দাবিতে অনড়। আবারও মহাজোটের নামে সব রাজনৈতিক দলকে তার নৌকায় উঠাতে সক্ষম হন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বিকল্পধারাও শেখ হাসিনার নৌকায় ওঠে তখন। কথিত এই সংস্কার দাবির যুক্তি ছিল ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে দেশে জ্বালাও-পোড়াও অসহযোগ ও হরতালের অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগায় বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। চারদলীয় জোট সরকারের সাজানো সেনা প্রশাসন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে জরুরি আইন জারি করে। দুই বছর জরুরি আইনের সরকার দোর্দণ্ড প্রতাপে ছিল। পরে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা এই ক্ষমতা পেয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান।

পাঁচ.

১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে কিন্তু প্রশ্নাতীতভাবে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন করা হয়নি; বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হয় দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও দুঃশাসনের মাধ্যমে।

আমি ধরে নিলাম, আগামী দু-এক মাসের মধ্যে মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলো। আরেকটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলো। দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হলো নির্বাচন। নির্বাচিত এমপিরা ভোটের পরের দিনই শপথ নিলেন। এরশাদের তৈরি করা আইন অনুযায়ী প্রত্যেকে একটি করে ট্যাক্স-ফ্রি দামি গাড়ি আমদানি করলেন। প্রত্যেকে ঢাকায় একটি প্লটের জন্য আবেদন করলেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাদের চাহিদামতো প্লট বরাদ্দ করা হলো, এমপি হোস্টেলে একটি বাসা বরাদ্দ পেলেন। অতীতের ধারাবাহিকতায় (এরশাদের তৈরি করা আইনে) গরিব ভোটারদের ভোটের মাধ্যমে তারা প্রাথমিক এই অধিকারগুলো আদায় করে নিলেন। কিন্তু তাতে ভূমিহীন গরিব ভোটারদের কী অর্জন হলো? অথচ এই ভূমিহীন গরিব ভোটারদের ভোটের বদৌলতেই এমপি সাহেব বাড়ি-গাড়ি ও লাল পাসপোর্টের অধিকারী হলেন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে—ভোটের অধিকারই যদি সমাধান হয়, তাহলে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নিরঙ্কুশ, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পর ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসার সুযোগ তৈরি হলো কীভাবে?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের নেতা শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। সঙ্গে তার মনোনীত ৩৪০ এমপি-মন্ত্রী সবাই উধাও হয়েছেন। রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারকরা জনরোষ থেকে রেহাই পেতে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিচার বিভাগ কতটা অধঃপতনে গেলে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারককে পালিয়ে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়! অথচ ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর মানুষ সর্বজনের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিকে খুঁজে নিয়েছিলেন সর্বসম্মতভাবে। ১৯৯১ সালে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনা বিবেচনা করলে কীভাবে রাষ্ট্রের অধঃপতন হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি ভোটের দরকার নেই? অবশ্যই ভোটের দরকার রয়েছে। ভোট গণতন্ত্রের প্রাথমিক একটি ধাপ। পাশাপাশি প্রয়োজন—১. স্বাধীন বিচার বিভাগ। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন যোগ্য ও দক্ষ বিচারক, যারা দলীয় ও ব্যক্তিচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে আইনের আওতায় থেকে বিচার করবেন। ২. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে অভিমত প্রকাশ করবে। জনগণের মুখপত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে গণমাধ্যম। ৩. আমলাতন্ত্রের জবাবদিহি থাকতে হবে। জবাবদিহিবিহীন আমলাতন্ত্র ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে কাজ করে। ৪. শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হলে আমলাতন্ত্র সব কুক্ষিগত করার সুযোগ পায়, যা গত ৫৩ বছরের ধারাবাহিকতায় প্রমাণ করে। ৫. প্রয়োজন দলীয় চাপহীন নিরপেক্ষ পুলিশ প্রশাসন। দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ পুলিশ প্রশাসন ছাড়া অপরাধের ভিকটিমের ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করে পুলিশ। তদন্তের ওপরই নির্ভর করে বিচার হয়। তদন্ত সঠিক না হলে ভিকটিম ন্যায়বিচার পায় না।

এ কাজগুলো করতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার। রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রকে জবাবদিহির আওতায় না আনতে পারলে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের ধারাবাহিকতায় নিরপেক্ষ ভোট হবে না। এতে ভোটে বিজয়ীরা তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি-বাড়িসহ অনেক লাভবান হবেন। পাঁচ বছরে বেহিসাবে অনেক থোক বরাদ্দ পাবেন, যার কোনো হিসাব কখনো দিতে হবে না। তবে দেশ চলবে ৫৩ বছরের ধারাবাহিকতায়। ঘুরেফিরে ফ্যাসিবাদ ফিরবে। বরাবরই লড়াই হবে। মানুষকে জীবন দিতে হবে।