ফেসবুকে মাসকাওয়াথ আহসানের একটা লেখা পড়ে আমার টনক নড়ল। আমি সচকিত হলাম। লেখাটি মাসকাওয়াথ লিখেছেন তার স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গাত্মক ধাঁচে। ব্যঙ্গ লিখায় এখন বাংলাদেশে মাসকাওয়াথের জুড়ি মেলা ভার। আমি তার প্রবল ভক্ত। তার কমেডি ধাঁচের লেখাগুলো আমার কাছে নিছক রঙ্গব্যঙ্গ মনে হয় না। পড়ে হাসতে গিয়ে অনেক সময় কণ্ঠ ছিঁড়ে কান্নাও এসে যায়। খুব গুরুতর বিষয়ও হাসির ছলে ব্যঙ্গের মোড়কে উপস্থাপন করতে জানেন তিনি। এই পারঙ্গমতার পেছনের চালিকাশক্তি হচ্ছে মাসকাওয়াথের পাণ্ডিত্য। তার নিজের জীবন ও পেশার বৈচিত্র্যের মতোই তার জ্ঞানও বর্ণাঢ্য। আর তাই মাসকাওয়াথ বয়সে কনিষ্ঠ হলেও এবং সব ক্ষেত্রে তার সঙ্গে একমত না হয়েও আমি তার অনুরক্ত ও গুণমুগ্ধ পাঠক।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতনের পটভূমিতে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার আলোচনাকে সামনে রেখে মাসকাওয়াথ লিখেছেন, ‘শুধু রাজনৈতিক দল বানালেই চলে না। এর পাশাপাশি কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হয়। যেমন একটি শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা একাডেমি গড়ে তুলতে হবে। এখানে গান শেখার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আদর্শে গড়ে তুলতে হবে শিশু ও কিশোরদের। আরেকটি বাউল সংগীত একাডেমি গড়ে তুলতে হবে, যার কাজ বাইরে বাউল সংগীত গাওয়া, ভেতরে ভেতরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আদর্শ প্রচার।’
তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা শহরে কিছু বুদ্ধিজীবীকে পদ-পদক-পদবি-প্লট দিয়ে পেলব করে তুলতে হবে। যাতে তারা নিয়মিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করবেন। এদের নিয়মিত ঘরোয়া আড্ডা হতে হবে, সেখানে থাকতে হবে শাস্ত্রীয় সংগীত ও ফ্রিতে দুই বোতল খুশিজল। বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে হাজার হাজার বই লেখাতে হবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী চেয়ার ও বৈষম্যবিরোধী স্টাডিজের চেয়ারম্যান হবেন।’
মাসকাওয়াথ তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘কিছু অভিজাত চেহারার ফর্সা ফর্সা আপা প্রয়োজন হবে; যারা বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসে থাকবেন ঊনবিংশ শতকের জমিদারের মেয়ের মতো।’ মাসকাওয়াথের পরামর্শ, ‘জুলাই চেতনাকে জনপ্রিয় করে তুলতে দরকার হবে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকা। সেখানে সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা, শিক্ষক ও সংস্কৃতিমামাকে দিয়ে কলাম লিখিয়ে; তাদের ভবিষ্যতে উপদেষ্টার আদলে গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি মনে করেন, ‘একটি কোমল রাজনৈতিক দলকে রাখতে হবে বৈষম্যবিরোধীদের সফট সমালোচনা করার জন্য। কিন্তু প্রয়োজন হলেই তারা মিন মিন করে বৈষম্যবিরোধীদের সুরে সুর মেলাবে। ১০ কিলোমিটার লম্বা পতাকা মিছিল করবে।’ তার পরামর্শ হচ্ছে, ‘পরিশেষে, ‘কাঁদো বৈষম্যবিরোধী কাঁদো’ বলে ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার মতো সাইবার গ্যাং গড়ে তুলতে হবে।... তারা বিবেককে নাড়া দিয়ে এমন করে কথা বলবে তাতে কোনো অপরাধ না করেও নিজেকে অপরাধী মনে হতে হবে সাধারণ মানুষের। কোনো কারণ ছাড়াই নিজেকে উচ্চবর্গের ও দেশের মালিক ভাবতে হবে; আর অন্যদের দয়া করে থাকতে দিয়েছে; এমন দেহভঙ্গি এনে ফেলতে হবে।’
এই লেখা পড়ে হাসতে হাসতে হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে উঠল আমার মুখ। আরে, এ তো সেই রাজনীতি, যা আমরা বাংলাদেশে যুগের পর যুগ ধরে দেখে আসছি! বিশেষ প্যাটার্নের এই রাজনীতিই তো আমাদের দেশে ‘আওয়ামী রাজনীতি’ হিসেবে চিত্রিত। এই রাজনীতির পদরেখাই তো আওয়ামী লীগকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছে উৎকট ফ্যাসিবাদের দুর্গে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতে নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলে জাইর বলসোনারো, রাশিয়ায় ভøাদিমির পুতিন, তুরস্কে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ফিলিপিন্সে রডরিগো দুতার্তে, ইসরাইলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, ভেনেজুয়েলায় হুগো শেভেজ ও নিকোলাস মাদুরো এবং হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান এই ধাঁচের রাজনীতি অনুসরণ করে আসছেন। তাদের কেউ এই রাজনীতির কোমল এবং কেউ কঠিন ফর্ম অবলম্বন করেন। তবে এসব দেশে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী থাকার কারণে বাংলাদেশের মতো খুব সহজে ফ্যাসিবাদের দিকে যাত্রা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষকরা অনেক দিন ধরেই এই ধারার রাজনীতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে আসছেন। এই দুষ্ট রাজনৈতিক ধারার তারা নাম দিয়েছেন ‘পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকস’। কেউ কেউ একে পোস্ট-ফ্যাকচুয়াল এবং কেউ কেউ পোস্ট-রিয়্যালিটি পলিটিকস নামেও অভিহিত করেছেন। তবে পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকস নামটিই বেশি মশহুর হয়েছে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে অক্সফোর্ড অভিধান প্রকাশক সংস্থা ‘পোস্ট-ট্রুথ’-কে বছরের সেরা আন্তর্জাতিক শব্দ হিসেবে নির্বাচিত করে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা এই পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতির ধারা খুব ভালোভাবেই অনুসরণ করেছেন। এই ধারার প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে : ১. মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য প্রচার, ২. আবেগতাড়িত বক্তব্য, ৩. বিভাজনের রাজনীতি এবং ৪. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার। পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকস বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই রাজনীতি আওয়ামী শাসনকে ফ্যাসিবাদী রেজিমে পৌঁছে দিয়েছিল। ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ওই রেজিমের পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ওই বিকৃত রাজনৈতিক ধারাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। গতানুগতিক ধারার রাজনীতি দিয়ে এই পোস্ট-ট্রুথ ধারাকে যে পরাজিত করা যায় না তা বিভিন্ন দেশে প্রমাণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা সমান সত্য। এর মোকাবিলায় প্রয়োজন পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস বা উত্তরাধুনিক রাজনীতি।
পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস এমন একটি ধারা, যা আধুনিকতাবাদের যুক্তিনির্ভরতা, সর্বজনীন সত্য এবং একমুখী কাঠামোগত চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি বিশ্বাস করে যে, সমাজে একাধিক বাস্তবতা থাকতে পারে এবং প্রতিটি বাস্তবতার নিজস্ব বৈধতা আছে। পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস বহুত্ববাদ, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি এবং বিভিন্ন মতামতের সহাবস্থানের ধারণাকে প্রাধান্য দেয়। পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকস যেখানে মিথ্যা তথ্য, বিকৃত আবেগ এবং একপক্ষীয় প্রচারণা দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করে, সেখানে পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস তথ্যের বৈচিত্র্য এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।
পোস্ট-মডার্ন পলিটিকসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : ১. বহুত্ববাদ : বিভিন্ন মত ও সংস্কৃতির সহাবস্থান। ২. সামাজিক নির্মাণবাদ : সত্যকে নির্দিষ্ট না ভেবে তা নির্ধারণে বিভিন্ন সামাজিক প্রভাবকে বিবেচনা করা। ৩. অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র : জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করা এবং ৪. তথ্যের মুক্ত প্রবাহ : বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সত্য যাচাইয়ের সুযোগ দেওয়া।
পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকস রোধে পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস যে ভূমিকা পালন করতে পারে :
১. বিকল্প উৎস : পোস্ট-ট্রুথ পলিটিক্সে সাধারণত একমুখী বা মনোপলাইজড তথ্য প্রচার হয়। পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস বিশ্বাস করে তথ্যের বিকল্প উৎস থাকা প্রয়োজন। এটি ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা তৈরি করে এবং জনগণকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সত্য যাচাইয়ের সুযোগ দেয়। ২. বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি : পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতের সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব দেয়। এটি সমাজে বিভাজন সৃষ্টির পরিবর্তে সমন্বয় ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে, যা পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকসের বিভাজনমূলক কৌশলকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে। ৩. আবেগতাড়িত রাজনীতির বিকল্প : পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতিতে আবেগ ও ভীতি ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করা হয়। পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস আবেগতাড়িত প্রচারণার পরিবর্তে যুক্তিভিত্তিক আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। ৪. ডিসকোর্স বিশ্লেষণ : পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস ভাষা ও ডিসকোর্স বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রচারণার ভেতরের উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা উন্মোচন করতে সাহায্য করে। এটি মিথ্যা প্রচারণার প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য বোঝার সুযোগ দেয়। ৫. নাগরিক ক্ষমতায়ন : পোস্ট-মডার্ন পলিটিকস জনগণকে ক্ষমতায়িত করে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে তোলে। এটি জনগণকে কেবল তথ্য গ্রহণকারী নয়, বরং তথ্যের সমালোচক ও বিশ্লেষক হিসেবে গড়ে তোলে।
বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত এই পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতি অনেকগুলো প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তারা সেই আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ফলে পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতি থেকে ফ্যাসিবাদে পরিণত হওয়া রেজিমকে তারা শত চেষ্টায়ও পরাজিত করতে পারেনি। কারা পেরেছে? পেরেছে ছাত্র-তরুণরা। তাদের প্রতি সাবেকী রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর সমর্থন অবশ্যই ছিল। কিন্তু ছাত্র-তরুণরাই ছিল আন্দোলনকে বিপ্লবী অভ্যুত্থানে উন্নীত করার কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাদের পারার কারণ হচ্ছে, পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকস নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো আচ্ছন্নতা ছিল না।
আওয়ামী পোস্ট-ট্রুথ পলিটিক্সে আবেগ সঞ্চারী কিছু উপাদান ছিল। ইতিহাসের আওয়ামী বয়ান, স্বাধীনতার তথাকথিত চেতনা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, সংবিধান, চার মূলনীতি, শেখ মুজিব, মুজিব বংশ ইত্যাদি। এসব মিথ, আইকন ও বিমূর্ত ধারণার ভিত্তিতে তারা একটা কল্পিত ‘পবিত্র বলয়’ গড়ে তোলে। আর পতাকা মিছিল, মোমবাতি প্রজ¦ালন, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানান আনুষ্ঠানিকতায় তারা ওই বলয়-কেন্দ্রিক আবর্তনকে আমাদের চেতনা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনীতির মূলধারা বলে আবেগ-সঞ্জাত প্রচারণা চালাত। এর সঙ্গে একীভূত না হলে কিংবা কোনো দাবি-দাওয়া তুললেই তারা রাজাকার বলে গালি দিয়ে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে দিত। তরুণরা সেই আবেগ ও আতঙ্ককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতির অপকৌশলকেই অকেজো করে দেয়। তারা ভয় না পেয়ে বলে দেয়, ‘হ্যাঁ তুমি আমায় রাজাকার বলেছ তাতে কিচ্ছু যায় আসে না, আমার দাবি মানো।’ তারা বলে, ‘মুজিব ও মুজিব বংশকে প্রশ্নাতীত আইকন বলে মানি না।’ তারা বলে, ‘তোমার মুজিববাদী সংবিধান ঠিক নাই।’ তারা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তোলে। চার মূলনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রশ্নে প্রশ্নে আওয়ামী পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকসকে তারা জরাজীর্ণ ও অকেজো করে ফেলে।
হাসিনার পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকসকে পরাস্ত করা ছাড়া তার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন সম্ভব হতো না। এই পরাজয়কে আজও মেনে নিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। তারা এখনো রাজনীতিকে নতুন করে বিন্যস্ত করার বদলে তালিজোড়া দিয়ে অকেজো পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকসকেই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, সন্ত্রাস, চক্রান্ত, অন্তর্ঘাত ও নাশকতাকেই তারা তাদের মূল কৌশল হিসেবে বহাল রেখেছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানকেও তারা বিদেশি চক্রান্ত এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গিদের ক্ষমতা দখল বলে প্রচার করছে। পরিত্যক্ত আইকন মুজিব ও মুজিব বংশ ঘিরে আবেগঘন প্রচারণা চালিয়ে ত্রাতারূপে পতিত হাসিনার প্রত্যাবর্তন সম্ভব বলে তারা স্বপ্ন দেখছে।
কেবল আওয়ামী লীগ নয়, দেশের ট্র্যাডিশনাল পলিটিক্যাল পার্টিগুলো কেউই সেই পোস্ট-ট্রুথ পলিটিকসের আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তারা ওই পলিটিকসের কাঠামোয় হাত দেওয়ার সাহস রাখে না। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নতুন বিন্যাস এবং সেকেন্ড রিপাবলিক গড়ার তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রায়োগিক সামর্থ্য তাদের নেই। তাই তারা কিছু কসমেটিক প্রলেপের মাধ্যমে পুরনো ব্যবস্থা ও কাঠামোই রেখে দিতে চায়। ‘তোমরা কিংবা আমরা’ এই বাইনারির বাইরে বেরুবার মতো ইচ্ছা তাদের মোটেও নেই। তারা মনে করে, দেশব্যাপী তাদের যে ‘নেটওয়ার্ক সোসাইটি’ আছে তারাই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ভোটের জোগান দিতে সক্ষম। এই মনে করাটা মিথ্যাও নয় এবং মিথ্যা নয় বলেই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বৈপ্লবিক সংস্কার ছাড়া অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ক্ষমতারোহণের সম্ভাবনা প্রায় অবশ্যম্ভাবী।
এতে অনেকে হতাশ হতে পারেন। তারা বলতে পারেন, ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতির বৈপ্লবিক সংস্কারই যদি না হবে তাহলে ফায়দা কী? এত রক্তপাত ও ত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে।’ আমি অবশ্য তা মনে করি না। আমি মনে করি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায় মৌলিক পার্থক্য ছিল এবং থাকবে। বিপ্লব মানুষকে ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দিলে রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের মতামত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য। আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি কখনো ‘উইনার্স টেক অল’ নীতিতে বিশ্বাসী নয়। অতীতে এমপিদের সার্বভৌম ক্ষমতার শাসন কায়েম করেছিল বিএনপি। তখন ছিল এমপিরাই সব ক্ষমতার উৎস। সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থনে সরকার গঠনের পর বিএনপি সংরক্ষিত আসনসহ কমবেশি সাড়ে তিনশ এমপির মধ্যে সব সুবিধা ভাগযোগ করে দিয়েছে। ট্যাক্স ফ্রি মোটর গাড়ি আমদানি থেকে শুরু করে সচিবালয়ের তদবির, ব্যবসা-বাণিজ্য, গ্রামের কাবিখা এবং স্থানীয় সব প্রতিষ্ঠানের কর্র্তৃত্ব ছিল এই এমপিদের হাতেই। তাদের অনিচ্ছার কারণেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। বিএনপি মতপ্রকাশ, মিডিয়া ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কম হস্তক্ষেপ করার দল। প্রশাসন ও পুলিশ হ্যান্ডেলের ব্যাপারে অবশ্য তাদের ভূমিকা খুব বেশি আলাদা নয়। তবে আওয়ামী লীগের মতো ভয়াবহ দলীয়করণ তারা করতে জানে না। তা ছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় জনসাধারণের মাইন্ডসেট ও আচরণে যে পরিবর্তন এনেছে তাতে এদেশে আর কারও পক্ষেই জবাবদিহিতাহীন ও কৈফিয়তশূন্য শাসন সহসা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। পরবর্তী সরকারকে কিছু না কিছু পরিবর্তন ও সংস্কার করতেই হবে।
উপসংহারে আমি বলব, আগামী নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক সংস্কারের দাবি ও চাহিদা তাতে প্রশমিত হবে না। উত্তরাধুনিক রাজনীতির ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকবে। বিএনপি বা ট্র্যাডিশনাল পার্টিগুলো যদি সেই ধারায় নিজেদের বদলে নিতে পারে তাহলেই মঙ্গল হবে সব দিক থেকে সবার।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব