- অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করীম
আব্দুল কাদের মোল্লা একটি স্মরণীয় নাম। তিনি আজন্ম নানা মহৎ ও আদর্শিক কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া প্রথম ব্যক্তি। তার মামলাটি দেশের ইতিহাসে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আজ তার শাহাদতের ১১তম বার্ষিকী। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে বিতাড়িত স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যারা ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩-এর সংশোধনের কথা বলছেন, তাদের জন্য আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাটি মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তার মৃত্যুদণ্ড শুধু একটি সেকেলে এবং ত্রুটিপূর্ণ আইনের ফসল নয়; বরং একটি অনুগত বিচারব্যবস্থার ফরমায়েশি রায় ছিল। শহীদ হওয়ার আগে বলে গেলেন, তাকে যেন তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। কোটি মানুষের ভালোবাসা ও চোখের পানিতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আব্দুল কাদের মোল্লা।
১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার জরিপ ডাঙ্গী গ্রামে নানাবাড়িতে আব্দুল কাদের মোল্লার জন্ম হয়। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্র্থ। শিক্ষাজীবনে প্রথম শ্রেণী থেকেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক (এসএসসি) এবং ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে থেকে পাস করেন উচ্চ মাধ্যমিক। একই বিদ্যাপীঠ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন। প্রথম যৌবনে চরিত্র মাধুর্যে সহপাঠীদের আকৃষ্ট করেন তিনি। সমবয়সীরাও অনেকে তাকে আপনি বলে সম্বোধন করত।
আব্দুল কাদের মোল্লা সদরপুর থানার বাইশরশি শিব সুন্দরী (এসএস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। সে সময় শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ মানুষরূপে তৈরির চেষ্টা ছিল তার। ফলে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শিক্ষাজীবনের ছেদ ঘটে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনিস্টিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ) বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে শিক্ষা প্রশাসনে ডিপ্লোমা পরীক্ষায় রেকর্ড মার্কস পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসনে মাস্টার্স ডিগ্রিতেও প্রথম হন।
১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকার উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে কিছুদিন রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। এরপর ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। পরে তিনি ছাত্রসংঘের ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রজীবন শেষে তিনি জামায়াতে যোগ দেন। একসময় আমিরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে ঢাকা মহানগরী শাখার সেক্রেটারি ও ১৯৮৮ সালের শেষভাগে ঢাকা মহানগরীর আমির এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হন। রাজনৈতিক কারণে কাদের মোল্লাকে বিভিন্ন মেয়াদে চারবার জেলে যেতে হয়।
তার সাথে প্রায় ৪০ বছরের পরিচয়। অনেক স্মৃতি বারবার মনে ভেসে ওঠে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রজীবন শেষ করে যখন জামায়াতে যোগ দিই, আব্দুল কাদের মোল্লা তখন ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি। দেখা হলেই জামায়াতের সাংগঠনিক স্তরে উন্নতি কতটা হলো জানতে চাইতেন। বলা যায়, তার উৎসাহ পেয়েই কিছুদিনের মধ্যে জামায়াতের রুকন হই।
কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে এবং গ্রুপভিত্তিক দাওয়াতি কাজে অংশ নিতেন। দাওয়াতি কাজ করতে গিয়ে অনেকসময় বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হতো। এমনকি গালিগালাজও শুনতে হতো। একদিন তেমনই এক বিরূপ পরিস্থিতিতে তিনি শুধু ভালো ব্যবহার ও সুন্দর কথা দিয়ে পরিস্থিতি এমনভাবে সামলে নেন, যা দাওয়াত পাওয়া ব্যক্তিকে মুগ্ধ করে। ক্রুদ্ধ লোকটি পরে সানন্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জামায়াতের দাওয়াত গ্রহণ করেন। এই ঘটনা তার সহকর্মীদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিতর্ক সভা, আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও জনসভায়ও অকাট্য যুক্তিনির্ভর বক্তব্য রাখতেন আব্দুল কাদের মোল্লা।
রাজনৈতিক কারণে বারবার কারানির্যাতন ভোগ করেছেন তিনি। কিন্তু দায়িত্ব পালনে কখনো শৈথিল্য দেখাননি। ছিলেন দৃঢ়চেতা ও অনড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মাঝে মাঝে বলতেন, একদিন তো মরতেই হবে, তাহলে শহীদ হয়ে মরতে পারলেই তো জীবন সার্থক। আল্লাহ তায়ালা কি তার এই শাহাদতের ইচ্ছা কবুল করেছিলেন!
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়