
অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর জন্য নানা পদক্ষেপের পরও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। শুধু ঘাটতি নয়, অর্থবছরের অর্ধেক সময় পার হলেও দেখা যায়, এ সময়ে রাজস্ব আহরণ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা; অর্থাৎ এ সময়ে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় ১ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে; যা দশমিক ৯৮ শতাংশ কম।
২০২৪ সালের জুনে বাজেট ঘোষণার পর মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রিজার্ভের পতনসহ অর্থনীতিতে নানা সংকট শুরু হয়। সে বছর জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং এর ধারাবাহিকতায় আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনের ধাক্কা ও সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার প্রেক্ষাপটে আমদানি, রপ্তানি ও উৎপাদনসহ অর্থনীতির সব সূচক মন্থর হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ কমার ধারাও অব্যাহত থাকে।
হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে গত বছর এ সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় দেখেছে ক্ষমতার পালাবদলের মাস আগস্ট। ওই মাসে তিন দিন সরকারবিহীন ছিল দেশ, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। কর আহরণ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়ে যেতে হবে আয়বর্ধিষ্ণু এলাকাগুলোর কাছাকাছি। কর আহরণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ খাতের দুর্নীতি কমিয়ে আনতেও শক্ত পদক্ষেপ কাম্য।
বিদ্যমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে কর আদায় অব্যাহত থাকলে কর আহরণে সুফল দেবে না। এরই মধ্যে গৃহীত রিরা (রিফর্মিং ইন্টারনাল রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবং ট্যাক্টস (ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অ্যান্ড ট্যাক্স পেয়ারস সার্ভিসেস) প্রকল্পগুলো বেশ কাজ দিয়েছে। এ ধরনের আরও উপকারী প্রকল্প গ্রহণে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তাও মিলতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের জিডিপি অনুপাতে কর ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে গড়ে অতিরিক্ত ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে। এ বাড়তি রাজস্ব বিভিন্ন খাতে সরকার বিনিয়োগ করলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়াবে।
২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম-এক্সপেনডিচার সার্ভে অনুসারে দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ ধনীর হাতে আর মোট ৩০ শতাংশ সম্পদ ওপরের স্তরের ৫ শতাংশের হাতে। তাদের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করতে পারলে এর চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব বাড়বে, আয়বৈষম্যও কমে আসবে। জিনি কোইফিশিয়েন্টের (আয়বৈষম্য নির্ধারণের পদ্ধতি) হিসাবে দেশে বৈষম্য ১৯৯০ সালে শূন্য দশমিক ৩৫ ছিল, তা এখন শূন্য দশমিক ৪৯-এ এসে গেছে। অর্থাৎ আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আসছে। দেশের দারিদ্র্য হয়তো সুনির্দিষ্ট হারে কমেছে, কিন্তু অর্থনীতির গতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্ব আদায় বাড়েনি।
আমাদের কর-ডিজিপির হার বাড়াতে হলে কর ফাঁকি দেওয়া ঠেকাতে হবে। অন্যদিকে আবার আইএমএফের কথামতো সেচের পানি, ডিজেল ইত্যাদির ওপর হরেদরে কর বাড়ানোও যাবে না। তবে এটাও হয়তো ঠিক, অনেক দিন ধরে চলে আসা, এমনকি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কিছু একপেশে ও ব্যক্তিগত অনুরোধ আর উপরোধে চলে আসা কর-রেয়াত বা অব্যাহতির বিষয়টি আমাদের গভীর বিবেচনায় নিতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। ক্রমবর্ধমান ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় বের করতে হবে। আইএমএফ এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জনগণকে ঋণের বোঝা বইতে হবে। বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো খুব শোচনীয় নয়। তবে আমাদের বহুমুখী ঋণদান সংস্থার চাপ মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ যে বাড়াতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন অর্থায়নের জন্যও এর বিকল্প নেই। স্থানীয়ভাবে রাজস্ব আদায়ের পথে তাই আনতে হবে অপরাপর দেশের অভিজ্ঞতায় অভিনবত্ব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, কর ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনতে পারলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়।
ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন