ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনাজপুর-৩ (সদর) আসনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে তার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকালে জমাও দেওয়া হয়েছে। তবে বিপত্তি ঘটেছে রবিবার দুপুরে একই আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক তিনবারের মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলছেন তাকে দল থেকে মনোনয়ন কিনতে বলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের মূল প্রার্থী কে হচ্ছেন কিংবা কে নির্বাচন করবেন, তা নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। বেশিরভাগ নেতাকর্মী দ্বিধাবিভক্তিতে ভুগছেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, রবিবার দুপুর পৌনে ২টায় দিনাজপুর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নূর-ই-আলম সিদ্দিকীর কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় জেলা বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক মামুনুর রশিদ কচি, সাবেক পৌর কাউন্সিলর রেহাতুল ইসলাম, মতিবুর রহমান বিপ্লবসহ দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে বিকালে বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন এবং বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছেন। তবে মনোনয়নপত্র নেওয়ার বিষয়টি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। যদিও জেলার শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলের হাইকমান্ডের এমন নির্দেশনার বিষয়ে কিছুই জানেন না, তাদের কিছুই জানানো হয়নি।
বিএনপি থেকে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত বুধবার খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। ওই দিন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ। সে সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি মাহবুব আহমেদ, আবু বক্কর সিদ্দিক, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান, দফতর সম্পাদক আখতারুজ্জামান প্রমুখ।
জেলা বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়। তাদের প্রত্যাশা, খালেদা জিয়া এই আসনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। তাকে বিজয়ী করতে কাজ করছিলেন তারা। এর মধ্যে হঠাৎ করে রবিবার দুপুরে একই আসনে মনোনয়নপত্র নেন দলের নেতা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি নিজেকে প্রার্থী হিসেবে দাবি করেন। এ অবস্থায় বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন দুলাল ও সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ। এ সময় জেলা বিএনপির সহসভাপতি মোকাররম হোসেন, খালেকুজ্জামান বাবু, মাহাবুব আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসনা হেনা হিরা, আনিসুল হক বাদশা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রবিবার খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন দুলাল ও সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ
জেলা বিএনপির সহসভাপতি মোকাররম হোসেন জানিয়েছেন, বিকালে জেলা বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে জানতে পারেন জাহাঙ্গীর আলম এই আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তখন তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। পরে তারা নেত্রীর পক্ষে মনোনয়ন জমা দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন দুলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে শনিবার বিকালে দলের নেতৃবৃন্দ এখানে আসেন। তাদের সঙ্গে সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমও ছিলেন। গত শুক্রবার আমাদের মহাসচিব ঠাকুরগাঁও সফরে যান। ঢাকা থেকে ফিরে জাহাঙ্গীর আলম বলতে শুরু করলেন, তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। যদি তিনি মনোনয়ন পেয়েই থাকেন, তাহলে খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়নপত্র উত্তোলন এবং জমা দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্র থেকে আমাদের কিছুই জানানো হতো না? নেত্রীর পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন না, এমন নির্দেশনা তো কেন্দ্র থেকে আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, খালেদা জিয়াই এখানকার প্রার্থী। অন্য কেউ নয়।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখবো যে, আসলে বিষয়টি কী। আমাদের দায়িত্ব ছিল খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, আমরা আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করেছি। তবে শেষ সময়ে জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়নপত্র নেওয়ায় নেতাকর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।’
অবশ্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার পর সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দলের উচ্চ পর্যায় থেকে দিনাজপুর-৩ আসনে আমাকে মনোনয়ন ফরম উত্তোলনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মনোনয়ন ফরম উত্তোলন করেছি। অবশ্য রবিবার বিকালে খালেদা জিয়ার পক্ষে এই আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি পৌরসভা ও দশটি ইউনিয়ন নিয়ে দিনাজপুর-৩ আসন। আমরা চাই অতীতকে ভুলে গিয়ে আগামী দিনে দিনাজপুর-৩ আসনে উন্নয়নমূলক কাজ করতে। এ জন্য আপনাদের বন্ধু হিসেবে, ভাই হিসেবে পাশে চাই। অতীতের ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে ঐক্যবদ্ধ থেকে পথচলার আহ্বান জানাই।’ চেয়ারপারসনের আসনে কেন মনোনয়ন নিলেন এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কেন্দ্রের নির্দেশনার বাইরে আমি কিছু বলতে পারবো না।’
দলীয় সূত্র জানায়, সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম ইতিপূর্বে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর টানা আরও দুবার নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনীত প্রার্থী হয়েছিলেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। পরে মেয়র পদে থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, আদালতের এমন আদেশে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়।
দিনাজপুর-৩ আসন থেকে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বোন প্রয়াত খুরশিদ জাহান হক।