Image description

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নের মগ্যাকার্বারী পাড়ার তরুণ উদ্যোক্তা সজিব চাকমা। স্থানীয়ভাবে সিদোল ও বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি উৎপাদন এবং মাশরুম চাষ করে এলাকায় সফলতার অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি। 

চার বছর আগে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হওয়া তার উদ্যোগ বর্তমানে পুঁজি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায়। এখন প্রতি মাসে লাখ টাকারও বেশি আয় করছেন তিনি। তার শুঁটকি ও মাশরুম উৎপাদন কার্যক্রম কেন্দ্র করে ২০-২৫ জন নারী পুরুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। 

জানা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর দিনমজুর বাবার সঙ্গে সংসারের দায়িত্ব নিতে সজিব চাকমা মোটরসাইকেল ভাড়া চালাতেন। কিন্তু দারিদ্র্যতা কাটিয়ে নিজের কিছু করার প্রত্যয় থেকেই তিনি প্রায় চার বছর আগে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে সিদোল (নাপতি) তৈরির কাঁচা চিংড়ি মাছ সংগ্রহ করে সিদোল উৎপাদন শুরু করেন। 

সিদোল স্থানীয় পর্যায়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় খাবার হওয়ায় এবং তার তৈরি সিদোলের গুণগত মান ভালো হওয়ায় সিদোল উৎপাদন করে সফলতা অর্জন করেন। এর এক বছর পর থেকেই সিদোল শুঁটকি উৎপাদনের পাশাপাশি কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে কাঁচা মাছ সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি তৈরি শুরু করেন। শুরুতে বিক্রিতে কিছুটা সমস্যা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্গানিক পদ্ধতিতে তৈরি তার সিদোল বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেলে। গুণগত মান ও স্বাদ ভালো হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে তার তৈরি সিদোল ও শুঁটকি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

বর্তমানে তিনি প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার কেজি সিদোল, দেড়শ থেকে তিনশ কেজি হাঙ্গর শুঁটকি, দুইশ কেজির মতো ছুরি ও শাপলা পাতা মাছের শুঁটকি এবং দুইশ থেকে আড়াইশ কেজি সুরমা ও বুলেট মাছের শুঁটকি উৎপাদন করেন। 

পাইকারি ধরে সিদোল বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৪২০ টাকা দরে। ছুরি ও বুলেট মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দরে আর শাপলা পাতা, হাঙ্গর ও সুরমা মাছের শুঁটকির দাম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সিদোলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এটির উৎপাদনই তিনি বেশি করেন।

শুঁটকির পাশাপাশি সজিব চাকমা সফলভাবে মাশরুম চাষ করছেন। বাংলাদেশ মাশরুম সেন্টার, সাভার থেকে ১ বছর আগে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি টিন, বাঁশ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করে মাশরুমের ঘর তৈরি করে হ্যাংগিং পদ্ধতিতে মাশরুম চাষ শুরু করেন। 

প্রতি সপ্তাহে তার চাষকৃত এক হাজার ৫০০ প্যাকেট থেকে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি মাশরুম উৎপাদিত হয়। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ২৮০ টাকা দরে বিক্রি করে মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। ঘর নির্মাণ, বীজ এবং যন্ত্রপাতি মিলিয়ে তার প্রাথমিক খরচ হয়েছিল ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।

তার শুঁটকি ও মাশরুম উৎপাদন কার্যক্রমে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন কাজ করা শ্রমিকের মধ্যে বেশিরভাগ নারী, যা স্থানীয় নারীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। পাশাপাশি সজিব চাকমা ২ একর বর্গা জমিতে ১ হাজার ৭০০ পেঁপের চারাসহ করলা এবং বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন, যা তার আয়কে আরও বৃদ্ধি করেছে।

সজিব চাকমার এখানে কাজ করা স্থানীয় নারী শ্রমিক মিনা চাকমা বলেন, অসুস্থ আর আকাশের অবস্থা খারাপ না থাকলে সজীব দাদার এখানে কম-বেশি সারা বছর কাজ করতে পারি। এর মাধ্যমে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়েছি আমরা। সজিব দাদার কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেলে আমাদের মতো আরও অনেক নারীরা কাজ করে তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারবে।

উদ্যোক্তা সজিব চাকমা বলেন, কঠোর ধৈর্য ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের প্রচেষ্টায় তিনি একটি ছোট্ট ব্যবসাকে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জানান, পাইকাররা সরাসরি তার বাড়িতে এসে শুঁটকি সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজন এবং অনলাইনে দেখে অনেকেই নিজ উদ্যোগে এসে বাসার জন্য শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি নিজে স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন এবং একই সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তার জন্য বড় একটি সৌভাগ্যের বিষয়। 

তবে আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ব্যবসা পরিচালনার জন্য মাঝেমধ্যে তাকে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করলেও নানা জটিলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। 

তিনি মনে করেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে তার ব্যবসার পরিধি আরও বিস্তৃত করা সম্ভব হবে এবং এতে আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে। তিনি আরও জানান, তার বাড়িতে যাওয়ার ইট সলিং রাস্তাটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। ফলে পণ্য পরিবহনের সময় তাকে অতিরিক্ত ভোগান্তির পাশাপাশি বাড়তি খরচও বহন করতে হচ্ছে, যা ব্যবসার অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গগন বিকাশ চাকমা বলেন, সজিব অর্গানিক পদ্ধতিতে শুঁটকি উৎপাদন ও মাশরুম চাষের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছেন। তার উদ্যোগে এলাকায় ২০ থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সজিবের এই সফলতা দেখে এলাকার তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। 

তিনি আরও জানান, সজিব চাকমার বাড়িতে রাস্তার কারণে পণ্য পরিবহনের অসুবিধার বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, রাস্তাটি সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দীঘিনালা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর (নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক) তৎযিম চাকমা বলেন, সজিব চাকমা সম্পূর্ণ কেমিক্যালমুক্ত পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করেন। সজিব চাকমার উৎপাদিত শুঁটকির নমুনা ২০২৩ সালে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ  দ্বারা পরিক্ষিত। তার তৈরি শুঁটকিগুলো সম্পূর্ণ অর্গানিক এবং নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। কোনোরকম ক্ষতিকর জিনিস ব্যবহার হয় না। তাই ভোক্তারা নিঃসন্দেহে তার উৎপাদিত শুঁটকি খেতে পারে।

দীঘিনালা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নিরুপন চাকমা বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে সজিব চাকমার মতো একজন ছেলে শুঁটকি, মাশরুম ও কৃষিপণ্য উৎপাদন করছে, নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি ২০-২৫ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে, এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তরুণদের উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করবে। দীঘিনালা যুব উন্নয়নের পক্ষ থেকে সজিবকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব আমরা।

এ বিষয়ে দীঘিনালা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান সুমন বলেন, সজিব চাকমা এক বছর আগে আমাদের সহযোগিতায় সাভার থেকে মাশরুম চাষের ট্রেনিং নিয়েছে। সে যে উদ্যোগ দেখিয়েছেন তা এ অঞ্চলের তরুণদের জন্য বড় ধরনের অনুপ্রেরণা। তিনি শুঁটকি ও কৃষিজ উৎপাদন দুটি ক্ষেত্রেই সফলভাবে কাজ করছেন। সঠিক পরিকল্পনা ও সহায়তা পেলে তার উদ্যোগ আরও বড় আকারে বিস্তৃত হতে পারে। আমরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। 

অল্প পুঁজি, কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে শুরু করা সজিব চাকমার ব্যবসায়িক যাত্রা এখন দীঘিনালার তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পেলে তার ব্যবসা আরও বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় কর্মসংস্থানও আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।