চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনে হামলার অভিযোগ ঘিরে যে গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কোনো প্রমাণ মেলেনি। মাঠপর্যায়ের তথ্য, দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে, ভারতীয় কূটনৈতিক কার্যালয়ে সরাসরি কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। তবে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সড়কে বিক্ষোভ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যাকে কেন্দ্র করেই ‘হাইকমিশনে হামলা’ শব্দটি ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
ঘটনার সূত্রপাত গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর। ওই খবরের প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম নগরীর কয়েকটি এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে প্রথমে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুরুতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। প্রথমে থাকা এই গ্রুপটিতে ছিল ১০-১৫ জন যুবক। রাত ১টা পর্যন্ত সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর, রাত ২টার দিকে ২০-২৫ জনের একটি দল ওই সড়ক দিয়ে বিক্ষোভ করতে করতে যেতে থাকেন। ওইসময় কার্যালয়ের সামনে ১০-১২ জনের পুলিশ টিম নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। বিক্ষুব্ধদের মধ্যে থেকে প্রথমে দুজন ইট ছুড়ে মারেন পুলিশের দিকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন আরো দুজন। ওই দুজনের নিক্ষেপ করা ইট সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনের গেট পর্যন্ত যায়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর জোনের উপকমিশনার (ডিসি) আমিনুর ইসলাম ওইদিন পুরো সময় ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জানান, ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের অফিসে হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার ভাষায়, একটি গ্রুপ ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরগুলো কার্যালয়ের বাইরের গেটে পড়েছে। এর বাইরে ভেতরে প্রবেশ, ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগের কোনো ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, রাত ২টার দিকে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। ওই সময় ১২ জনকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যালোচনা করেন। পরে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, চট্টগ্রামে ভারতীয় কোনো কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে ওই রাতের ঘটনার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় স্লোগান দিচ্ছেন এবং একপর্যায়ে কয়েকজন দূর থেকে পাথর ছুড়ে মারছেন। পাথরগুলো কার্যালয়ের বাইরের ফটকে আঘাত করছে। তবে কোথাও ভবনের ভেতরে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর বা আগুন লাগানোর কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। ভিডিওতে পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের দৃশ্যও রয়েছে, যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সময় ধারণ করা।
এ ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনীর দুটি ক্যাম্প থেকে আসা প্রায় ৫০ জন সদস্য দ্রুত ঘটনাস্থলে মোতায়েন হয়ে পুরো এলাকা নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখে। সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবন ও আশপাশের সড়কে সেনাসদস্যরা অবস্থান নেন, যাতে নতুন করে কেউ জড়ো হতে না পারে এবং পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত না হয়। তাদের উপস্থিতির পর এলাকায় উত্তেজনা কমতে শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেনাবাহিনী আসার পর বিক্ষোভকারীদের বড় একটি অংশ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সেনাসদস্যরা পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে সমন্বয় করে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন এবং আশপাশের গলিপথে টহল জোরদার করেন। নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে থাকা কোনো কূটনৈতিক স্থাপনায় তখন আর কোনো ধরনের হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, পরিস্থিতি যাতে কূটনৈতিক সংকটে রূপ না নেয়, সে কারণেই সেনাবাহিনীকে দ্রুত মাঠে নামানো হয়। রাতভর যৌথ নজরদারি চালানো হয় এবং ভোরের দিকে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে অতিরিক্ত সেনাসদস্যদের ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হয়।
নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত আইনশৃঙ্খলা মোতায়েন গুজব ও বাস্তব ঘটনার মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট করতে এবং সংবেদনশীল স্থাপনা ঘিরে সম্ভাব্য ঝুঁকি ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ওইদিন ঘটনাস্থলে থেকে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেন একটি জাতীয় অনলাইন পোর্টালের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি। তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাতের শুরু থেকেই এলাকায় উত্তেজনা থাকলেও ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয়ে সরাসরি কোনো হামলার চিত্র তিনি দেখেননি। তার ভাষায়, বিক্ষোভকারীরা মূলত সড়কে অবস্থান করছিল। কিছু সময় পর কয়েকজন দূর থেকে পাথর ছোড়ে। পাথরগুলো কার্যালয়ের বাইরের গেটে লাগে। কিন্তু কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেনি, কোনো কক্ষ ভাঙচুর বা আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেনি।
পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্য, সিএমপি কমিশনারের পরিদর্শন, ভিডিও বিশ্লেষণ এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বক্তব্যে ভারতীয় কূটনৈতিক কার্যালয়ে হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক স্থাপনার মতো সংবেদনশীল স্থানের নাম জড়িয়ে পড়লে যে কোনো ঘটনাই দ্রুত গুরুত্ব পায়। কিন্তু যাচাই ছাড়া ‘হামলা’ শব্দ ব্যবহার করলে তা জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভুল বার্তা পৌঁছাতে পারে। তাদের মতে, এ ধরনের ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই প্রভাবিত করে না, বরং কূটনৈতিক সম্পর্কেও অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, সংবেদনশীল কূটনৈতিক স্থাপনা ঘিরে গুজব ছড়ানো একটি পরিকল্পিত অস্থিতিশীলতার কৌশলও হতে পারে। বাস্তবে ছোট আকারের বিক্ষোভ বা বিচ্ছিন্ন পাথর নিক্ষেপের ঘটনাকে ‘হামলা’ হিসেবে উপস্থাপন করলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরো বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের নামে যাচাইহীন বা বিকৃত তথ্য রাজনৈতিক বলয়ে ঘুরতে থাকলে সেটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য বড় ঝুঁকি। এ ধরনের তথ্যপ্রবাহ দ্রুত ফ্যাক্টচেক করা না হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে।
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামানের মতে, প্রশাসনের উচিত ঘটনার পরপরই একক, স্বচ্ছ ও তথ্যভিত্তিক ব্রিফিং দেওয়া যাতে সত্য-মিথ্যার ফারাক স্পষ্ট থাকে। একইসঙ্গে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণ ও মিডিয়ার ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া জোরদার করা না গেলে ভবিষ্যতে এমন গুজব আরো বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে।