দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চলছে শীতকালীন ছুটি। নিয়ম অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম দিকে নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এর আগেই কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট ব্যাচগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রায় শেষ। পরীক্ষার সময় থেকেই কোচিং ও প্রাইভেটের জন্য ভর্তির তোড়জোড় শুরু হওয়ায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কোচিং–প্রাইভেট বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়েও কোচিং বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে একদিকে যেমন অভিভাবকদের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের প্রতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই
কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের নীতিমালা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এর কোনো কার্যকর বাস্তবায়ন নেই। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরেই কোচিং–প্রাইভেটের বিস্তার সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্যে লাগাম টানতে নতুন করে উদ্যোগ নিচ্ছে বর্তমান সরকার। সম্প্রতি প্রকাশিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা–২০২৫-এ কোচিং বাণিজ্য বন্ধের স্পষ্ট নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। নীতিমালার ২৪ নম্বর ধারার ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য থেকে বিরত থাকবেন।
এ ছাড়া কোচিং বাণিজ্য বন্ধ সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা চিহ্নিত করে নীতিমালাটি যুগোপযোগী করার প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা না মানলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে বিবেচনায় না নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
২০১২ সালের নীতিমালার কথা
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলুর করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ প্রণয়ন করে, যা ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। তবে বাস্তবে আজ পর্যন্ত নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায়নি।
ওই নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের (নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়), কলেজ (উচ্চমাধ্যমিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) মাদরাসা (দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল) ও কারিগরির এক শ্রেণির শিক্ষক দীর্ঘদিন যাবৎ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোচিং পরিচালনা করে আসছেন। এটি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিংবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন; যা শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ সম্পর্কিত হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর কোচিংবাণিজ্য বন্ধে একটি গেজেট নোটিফিকেশন বা অন্য কোনোরূপ আদেশ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিংবাণিজ্য বন্ধে সরকার কর্তৃক এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো।
নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এ ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল নং, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে। কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হতে বা মালিক হতে পারবেন না।
নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এই নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই বলে জানা গেছে। এছাড়া নীতিমালা বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা থাকলেও বাস্তবে এসব কমিটির কোনো সক্রিয়তা নেই বলে জানা গেছে।
অভিভাবকদের অভিযোগ
রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার অভিভাবকরা জানান, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালেই কোচিং সেন্টারগুলো ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষকরা নিজস্ব প্রাইভেট ব্যাচে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য চাপাচাপি করেন। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরাই বেশি প্রাইভেট পড়ান। শিক্ষকদের মান অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও ফি বেশি। স্কুলে ভর্তির আগেই কাঙ্ক্ষিত কোচিং বা প্রাইভেটে সন্তানদের ভর্তি করাতে অনেকটা বাধ্য করা হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, তুলনামূলক খরচ কম হওয়ায় অনেকে তাদের সন্তানদের কোচিং বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনার শিক্ষকের কাছে পড়াতে চান। ক্লাস শিক্ষকের কাছে না পড়ালে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ দেওয়া হয় এবং যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়—এমন অভিযোগও করেন অভিভাবকরা। সেজন্য বাধ্য হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে হলেও শ্রেণি শিক্ষকদের কাছে পড়াতে হয় সন্তানদের। বাড়তি এ খরচ জোগাতে অনেক অভিভাবককে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে অতিরিক্ত কোচিং ও প্রাইভেটের কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে মানসিক ও শারীরিক সমস্যাও। কারণ প্রাইভেটে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে স্কুলের ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোরই মনোযোগ বা আগ্রহ থাকে না। ক্লাসে দীর্ঘক্ষণ সময় পার করার পর দফায় দফায় প্রাইভেট-কোচিংয়ে ব্যস্ত থাকায় শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো খাওয়া ও বিশ্রামের সময় পায় না। একদিকে অনিয়মিত খাবার গ্রহণ, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় পড়ালেখায় ব্যস্ত থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত হয় তারা। এতে অনেকেই মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় পড়ছে। তাছাড়া কোচিং-প্রাইভেটনির্ভরতা বা ক্লাস টিচারদের মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা পেয়ে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও অন্যান্য পরীক্ষায় পড়ছে বলে অনেকের অভিমত।
সরকারের পদক্ষেপ ও বক্তব্য
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সব শিক্ষক-কর্মচারী কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের তথ্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়। গত ৩ ডিসেম্বর দেওয়া চিঠিতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে রাজশাহী অঞ্চলের সব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
এ বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা দেয়নি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তবে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মাউশির মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টার একান্ত সচিব (উপসচিব) এ কে এম তাজকির-উজ-জামান বলেন, শুধু আইন করলেই হবে না। ২০১২ সালের নীতিমালা কেন বাস্তবায়ন হয়নি, তার কারণ খুঁজতে হবে। এজন্য নীতিমালাটি যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের পরামর্শের ভিত্তিতেই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হবে।
আইনের দাবি
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। মনিটরিং কমিটিও দায়িত্ব পালন করেনি। তাই নীতিমালা নয়, আইন করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। তবেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।