Image description
চলে গেল ১১ হাজার কোটি টাকা

প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ব্লকচেইন প্রযুক্তির মুদ্রায় রূপান্তরের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার করেছে একটি সাইবার অপরাধী চক্র। অভিনব এই পন্থায় অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠে এই চক্রের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ তদন্তের পর ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তরিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকা জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। টাকা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় পরীক্ষামূলক লেনদেনে সফল হয়েছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি)। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। তারা বলছেন, ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচারের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে টাকা ফিরিয়ে আনার ঘটনা এটিই প্রথম। দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন-সংক্রান্ত আইন না থাকা এবং পুলিশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কম থাকায় এটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলে এই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া সব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কানাডাভিত্তিক ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জের (এমটিএফই) বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের আগস্টে দেশ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগীর মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে চলতি বছরের মার্চে ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ইউএসডিটি (ক্রিপ্টোকারেন্সি ভিত্তিক ডিজিটাল মুদ্রা) জব্দের কথা জানায় সিপিসি। যার পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। এরপর গত ২৪ নভেম্বর চুক্তিভিত্তিক একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে সিআইডির খোলা অ্যাকাউন্টে পরীক্ষামূলক লেনদেন চালানো হয়। এতে ইউএসডিটি থেকে মার্কিন ডলার, এরপর টাকায় রূপান্তরের মাধ্যমে লেনদেনটি সফল হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাকি টাকা সিআইডির ব্যাংক হিসাবে ফেরত আনার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরপর প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফিরিয়ে দিতে করণীয় নির্ধারণ করবেন আদালত।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক সিপিসি’র একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমাদের পরীক্ষামূলক লেনদেন সফল হয়েছে। শিগগিরই জব্দ হওয়া পুরো টাকা ফিরিয়ে আনা হবে। তদন্তে আমরা আরও তথ্য পেয়েছি, যা এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আশা করি বাকি টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

জানা গেছে, এমটিএফই ভুক্তভোগীদের টাকা ডলার থেকে ইউএসডিটিতে রূপান্তরের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের মাধ্যম ওকেএক্সে থাকা নিজেদের ওয়ালেটে জমা করে। তবে দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের আইন না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়েন কর্মকর্তারা। পরে ঢাকার একটি আদালতে এসব তথ্য উপস্থাপন করলে টাকা ফিরিয়ে আনার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ওকেএক্সের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণের মাধ্যমে ইউএসডিটি জব্দের আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওকেএক্সে থাকা এমটিএফই’র ইউএসডিটি জব্দ হয়। এরপর শুরু হয় জব্দ হওয়া মুদ্রা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া। সরাসরি ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের বিধান না থাকায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক ডিজিটাল এবং ক্রিপ্টো সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থা অ্যাসেট রিয়েলিটি লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

অ্যাসেট রিয়েলিটি জানায়, ওকেএক্সে থাকা জব্দকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সি তারা নিজেদের কাছে নিয়ে সমপরিমাণ বৈধ মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠাবে। এরপর পুরো কাজের জন্য রূপান্তরিত অর্থের আড়াই শতাংশ তাদের দেওয়ার শর্তে চুক্তি করে সিপিসি। এরপর এই অর্থ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে একটি হিসাব চালু করেন সিপিসি কর্মকর্তারা। দেশে প্রথমবার জটিল প্রক্রিয়ায় অর্থ গ্রহণের পরীক্ষামূলক লেনদেনে সফল হন তারা। পুরো কার্যক্রমে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস সিপিসিকে সহযোগিতা করেছে।

এমটিএফইর প্রতারণা : এমটিএফই ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ফরেক্স ট্রেডিংয়ে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে। এমএলএমের মতো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্থানীয় দলনেতারা মানুষকে তাদের সঞ্চয় বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন শিক্ষিত ও প্রযুক্তিবান্ধব। বিনিয়োগের জন্য কেউ সম্পদ বিক্রি করেছেন, আবার অনেকেই ঋণ নিয়ে টাকা জোগাড় করেছেন। প্ল্যাটফর্মটি শুরুতে ভুয়া মুনাফা দেখিয়ে আস্থা অর্জন করে এবং ২০২৩ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ টাকা উত্তোলন বন্ধ করে উধাও হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া ১১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের।

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে অ্যাপটিতে কেউ ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন তাকে লাভ দেওয়া হতো প্রায় ১৩ ডলার। বিনিয়োগ যত বেশি হতো সে সময় লাভের পরিমাণও তত বেশি দেওয়া হতো। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মাঝেমধ্যে লোকসানও দেখানো হতো। এজন্য ৫ হাজার, ১০ হাজার, এমনকি ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন অনেক গ্রাহক। বিনিয়োগের ওপর সব মিলিয়ে মাসে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ পাওয়া যেত। এ লাভ আবার মাঝেমধ্যে দ্বিগুণও করে দেওয়া হতো। শুধু বিনিয়োগের ওপর লাভই নয়, কোনো গ্রাহক নতুন কাউকে দিয়ে বিনিয়োগ করাতে পারলে তাকে লাভের ওপর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দেওয়া হতো। এভাবে কারও মাধ্যমে ১০০ গ্রাহক বিনিয়োগ করলে ওই ব্যক্তিকে ‘সিইও’ পদবিও দেওয়া হতো।

এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেছিলেন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার মো. মারুফ রহমান মাহিম। বিদেশে পলাতক এমটিএফইর ‘অ্যাম্বাসেডর’ মুবাশসিরুল ইবাদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে পরিচয় ছিল তার। তিনি বলেন, মুবাশসিরুল ইবাদের মাধ্যমে এমটিএফইতে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা অনেক টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হই।