Image description
 

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর বর্বরোচিত হামলা কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার প্রাণনাশের চেষ্টা নয়, বরং এটি সমকালীন বাংলাদেশের মব কালচার বা গণপিটুনি সংস্কৃতির এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। ১৩শ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন দিনদুপুরে তাঁর মাথায় গুলি চালানো হয়। বুলেটটি মাথার একদিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেও অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে আছেন এবং বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন।

 

হাদির ওপর হামলার খবর সংগ্রহের জন্য ঢাকা মেডিকেলে দ্রুত হাজির হন চ্যানেল ওয়ানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রিফাত রিসান। কিন্তু সেখানে তিনি কোনো তথ্য পাওয়ার বদলে চরম মব সন্ত্রাসের শিকার হন। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নেতার ওপর হামলার ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু গণমাধ্যমকে ‘হত্যাকারী’ আখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাটি সুপরিকল্পিত কি না, সেই প্রশ্ন উসকে দিয়েছে।

রিফাত জানান, ফুটেজ নেওয়ারত অবস্থায় আচমকা কয়েকজন এসে কোনো কথা ছাড়াই আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে "আমি হাদিকে গুলি করেছি"- এরকম একটা কথা ছড়িয়ে দেয়। এবং তাৎক্ষণিক মব তৈরি করে সেখানে। এরপর চারদিক থেকে শুরু হয় আমাকে কিল-ঘুসি,খামচি দেওয়া। আমার পরিহিত পাঞ্জাবি টেনে ছিড়ে ফেলা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে দ্রুত বের হতে চাইলে হামলাকারীরা দৌঁড়ে আমাকে মারধর করতে থাকে। একপর্যায়ে রাস্তায় ফেলে লাথি মারতে থাকে। আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দেয়না।

 

তিনি আরো জানান, ইমার্জেন্সির বাইরে তখন লাইভের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্টার নিউজের ঢাবি প্রতিনিধি লিটন ইসলাম ভাই। দূর থেকে আমাকে চিনতে পেরে দ্রুত বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। তখনও হামলাকারীরা আমাকে ছাড়ে না। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজেও কিল-ঘুষির শিকার হন। মারধরের ফলে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ি একটা সময়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ, আনসার কেউ তখনো সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

 

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার'-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাংবাদিকদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দেশীয় পরিসংখ্যানও আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে:  বছরের প্রথম ৭ মাসে ২১৮ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার, যার মধ্যে ২৬৬ জন বিভিন্ন মামলার আসামি এবং ৩ জন দায়িত্ব পালনের সময় নিহত।

মব তৈরির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি আদৌ কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ দেখায়? রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কি কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়? চোখের সামনে সাংবাদিক নিগ্রহ দেখেও কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরই যদি নেতিবাচক হয়, তবে বুঝতে হবে সতর্ক হওয়ার সময়টুকুও আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে সমালোচনা বা সংক্ষুব্ধতা থাকতেই পারে, কিন্তু মব তৈরি করে কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত বা মেরে ফেলার অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। মনে রাখা জরুরি, গণমাধ্যম হলো সমাজের আয়না। এই আয়না যদি মব সন্ত্রাসের ভয়ে ভেঙে ফেলা হয়, তবে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রকৃত রূপটি দেখার আর কোনো পথ বাকি থাকবে না।